দুদলের অনড় অবস্থান
আরও ঘনীভূত হবে সংকট বাড়বে সংঘাতও
হাসিবুল হাসান
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থান পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পালটাপালটি কর্মসূচি স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কর্মসূচি ঘিরে প্রায়ই ঘটছে সহিংস ঘটনাও। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে সংকট আরও ঘনীভূত হবে, বাড়বে সংঘাতও। এতে জনগণ যেমন পিষ্ট হবে তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও অর্থনীতি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার পরামর্শ পরার্মশ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
তারা বলছেন, এ সংকটের সমাধান রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে। দেশ, অর্থনীতি ও মানুষের জন্য ছাড় দিতে হবে। পাশাপাশি দেশ ও অর্থনীতির ক্ষতি হয়-এমন কর্মকাণ্ড থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিরত থাকতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনো দুই মেরুতে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল। সংবিধান মেনে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে অনড় আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি। এ নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনও করছেন তারা। সম্প্রতি সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে দলটি। অন্যদিকে একই দিনে রাজপথে পালটা কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগও।
বর্তমানে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এক বা একাধিক দিনে একই সঙ্গে বড় বড় সমাবেশ করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ পালটাপালটি মানতে রাজি না হলেও দেখা যাচ্ছে বিএনপির কর্মসূচির দিনেই তারাও কর্মসূচি দিচ্ছে। বিএনপি কর্মসূচি পেছালে আওয়ামী লীগও নানা কারণ দেখিয়ে তাদের কর্মসূচি পেছাচ্ছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাজধানীতে দুদলের বড় সমাবেশ করার কথা ছিল। পরে স্থান নিয়ে জটিলায় কর্মসূচি পেছায় দুদলই। আজ রাজধানীতে সেই সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে দল দুটি। এই কর্মসূচি ঘিরে বড় শোডাউনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।
এদিকে বুধবার যুত্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন। এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলোকে যেভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে সেটি নিয়েও সিভিল সোসাইটি চিন্তিত। বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল অনেক দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার শাসন করছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের দেশে যেটা হয়-ক্ষমতাসীন দলেও গণতান্ত্রিক চর্চা থাকে না, একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও গণতান্ত্রিক চর্চা থাকে না। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। এখন আমরা বহু বছর কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনে আছি। উন্নয়নও কিছুটা নিঃসন্দেহে হয়েছে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে উন্নয়ন হলেও বহু দেশেই অনিবার্যভাবে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমার আশঙ্কা-আমরাও সেই ফর্মুলার মধ্যেই পড়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, একে তো অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে অবস্থার সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে অবস্থান যদি বিপক্ষে যায় তাহলে তো অবস্থা আরও করুণ হবে। সাধারণ নাগরিকদের অবস্থা আরও জটিল হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতির সমাধান প্রসঙ্গে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এর সমাধান আমরা সবাই জানি। এক কথায় বললে উভয়পক্ষকে ছাড় দিতেই হবে। ছাড় না দিলে হাটিহাটি পা পা করে সংঘাতের দিকেই এগিয়ে যাবে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছাড় দেওয়ার কোনো মানসিকতা দেখছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি-আমি ভুল। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে যা দেখি তাতে আশাবাদী হওয়ার জায়গা দেখি না। তবে আবারও বলছি-আমি আশাবাদী হতে চাই।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব বদিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, উৎকণ্ঠা এজন্যই সৃষ্টি হয়েছে কারণ রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নিয়মমাফিক নেই। এখন রাজনীতি হয়ে গেছে ব্যবসা। জনগণের সত্য কথা বলার সুযোগ নেই। সত্য বলতে গেলে তাদের ওপর দুই পক্ষ থেকেই আঘাত আসে। ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।
’ আমাদের অবস্থাও এমন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি একটা শিল, আরেকটা পাটা, তাদের ঘষাতে জনগণ মাঝখানে পিষ্ট হচ্ছে। এই দুটি দল কেউই এখন আর নীতির রাজনীতি করছে না। তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করছে। তারা একজন যে কোনো ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। আর অন্য দল যে কোনো ভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি জানতে চাইলে বদিউর রহমান বলেন, আমি চাই সংবিধানের আলোকে সমাধান হোক। সেটা বর্তমান সংবিধান হতে হবে সেটা নয়, প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। আবার আমি মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক বা অনির্বাচিত সরকারও কোনো সমাধান নয়। আমি চাই রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক। সেখানে যারা ক্ষমতায় আছে তারা থাকল, বাইরে থেকেও নিল। মোট কথা গ্রহণযোগ্য একটা পন্থায় রাজনীতিবিদদেরই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ২০০৮-০৯ থেকে আমাদের রপ্তানির গ্রোথটা যেভাবে হয়েছে, এটা অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক কোনো অস্থিরতা ছিল না। ব্যবসার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ খুবই জরুরি। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে বায়াররাও ভীতিতে থাকেন। ফলে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে দেখা যাবে বায়াররা আসবে না।
এটা আমাদের একটা শঙ্কার কারণ। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, যেভাবে পালটাপালটি কর্মসূচি হচ্ছে, এটা আসলে সব সময়ই অর্থনীতির জন্য খারাপ। এগুলো অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা সব সময় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। সরকারের ধারাবাহিকতাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ বা উন্নতির জন্য এটা থাকাটা খুব জরুরি। যেমন গত ১৪-১৫ বছর আমরা যে সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি।
ফলে আমাদের আহ্বান থাকবে-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, তবে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি যেন কেউই না দেন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয় এমন কর্মকাণ্ড যেন কেউ না করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।