মৃত্যু ২০০ ছাড়াল মহামারির পথে ডেঙ্গু
একদিনে রেকর্ড ভর্তি ২৪১৮, মৃত্যু ১৬
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এক ভীতিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। গত একদিনে রেকর্ড ২ হাজার ৪১৮ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় একজন সিনিয়র সহকারী সচিব, একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ও মেডিকেলের এক ছাত্রীসহ ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়াল। সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, ডেঙ্গুর এমন ভয়াল থাবায় কে কখন আক্রান্ত হবেন, কার কখন জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে-এ এক অনিশ্চিত শঙ্কা। আতঙ্কিত দেশের সাধারণ মানুষ। আতঙ্কিত সব শ্রেণি পেশার মানুষ। ‘ডেঙ্গু ঢাকার মানুষকে আক্রমণ করে’ এমন কথা মুখে মুখে থাকলেও বাস্তবে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি সমান্তরালভাবে অবনতি ঘটছে। গত এক সপ্তাহে পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে জুলাইয়ে। ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা আশপাশের বছরগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। পরিসংখ্যান আঁতকে ওঠার মতো।
চারদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়ে এত শঙ্কা, স্বজন হারানোর হাহাকার, চিকিৎসা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দোলাচল-এমন এক করুণ পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের যে তথ্য জনসম্মুখে আসছে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে তা বাস্তব অবস্থার চেয়ে অনেক কম। পুরো চিত্র যখন সামনে আসবে তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, ধারণারও বাইরে। বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, পরিস্থিতি এতই নাজুক যে, ডেঙ্গু এখন মহামারির দিকে হাঁটছে।
এদিকে সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২ হাজার ৪১৮ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সংখ্যা এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ। সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন রেকর্ড ২ হাজার ২৯৩ জন। পরদিনই ভর্তি রোগীর সংখ্যার আগের রেকর্ড ভাঙল। নতুন ভর্তি হওয়াদের নিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৩৭ হাজার ৬৮৮ জনে। এর মধ্যে জুলাইয়ে ২৫ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার ৭১০ জন। গত একদিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে ঢাকায় ১৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ জন। সব মিলিয়ে এ বছর ২০১ জনের মৃত্যু হলো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, গত একদিনে ভর্তি রোগীর মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগী বেশি। ঢাকায় ১ হাজার ১৬২ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৫৬ জন রোগী। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৭ হাজার ৯২৭ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৬৪৬ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩ হাজার ২৮১ জন।
১৯ থেকে ২৫ জুলাই গত এক সপ্তাহের সারা দেশে ১৩ হাজার ৬৮৮ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ৭৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৬ হাজার ৮৭৩ জন ঢাকায় এবং ৬ হাজার ৮১৫ জন ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গুতে ঢাকায় ৬৬ এবং ঢাকার বাইরে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিশ্চিত করেছে। জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, মৃত্যু হয়েছিল ৩৪ জনের। জুলাইয়ের ২৪ দিনে সেই সংখ্যা বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে। মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন এবং জুন মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হেলথ বুলেটিনের তথ্য বলছে, দেশে ৬৪০টি সরকারি এবং ৫ হাজার ৫৭৭টি নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু অধিদপ্তর সরকারি হাসপাতালের বাইরে শুধু ঢাকার ৫১টি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর তথ্য দিচ্ছে। ডেঙ্গুর বর্তমান চিত্র যখন মহামারির পর্যায়ে চলে গেছে জানিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য না থাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তর সব হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এতে করে ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না। সঠিক চিত্র পেতে হলে এলাকাভিত্তিক কতজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে সেই তথ্য জানা দরকার। সব হাসপাতালের তথ্য না পাওয়ায় সারা দেশে কত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে সেটিও জানা যাচ্ছে না। অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। বলা হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ দৈনিক যদি ৩৩ হাজার রোগী হয়, প্রকৃত সংখ্যা হবে প্রায় এক লাখ। এতবড় সংখ্যার প্রকৃত হিসাব মানুষকে জানাতে পারলে সবার মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হতো। মশার কামড় থেকে বাঁচতে সতর্ক হতো। সরকারও এটিকে সমস্যা ধরে এই খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, লোকবল বাড়ানো, সরঞ্জাম সরবরাহের কাজগুলো দ্রুত করত। কিন্তু সঠিক চিত্র না পাওয়ায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল তা হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. রাশিদা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গুর সম্পূর্ণ তথ্য জানাতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম শাখাকে (এমআইএস) বারবার তাগাদা দিচ্ছি। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে না। মূলত বেসরকারি হাসপতালগুলো এ বিষয়ে ট্রেইনআপ না। ফলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বিষয় হচ্ছে, যতই সুবিধা বাড়াই, তথ্য সংগ্রহ করি না কেন, মশা নিধন না করতে পারলে কোনোভাবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহাদত হোসেন যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, ডেঙ্গু নিয়ে সরকারি সব হাসপতালে ভর্তি ও মৃতের দৈনিক তথ্য দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় ৫১টি, চট্টগ্রামে ৭টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য আসছে। এরসঙ্গে বিভাগীয় পর্যায় থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানেও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতা-ক্লিনিকের তথ্য রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারির মতো বেসরকারি হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্তকরণ আগে হয়নি। এখন আনার চেষ্টা চলছে। এখন বেসরকারি হাসপাতালের লাইসসেন্স দেওয়ার আগে সেখানে সব ধরনের তথ্য অধিদপ্তরকে দেওয়ার একটি আইন সংযুক্ত করার চেষ্টা চলছে। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রেও তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি দেখা হবে। এলক্ষ্যে বেসরকারি বডির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা কি কি তথ্য দেবে সে ব্যাপারে কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুত বেসরকারি তথ্য জানানো সম্ভব হবে। তবে অধিদপ্তর চাইলে এখনো দিতে পারে। কিন্তু তারা সেটি করছে না।
জনস্বাস্থ্যবিদরা যুগান্তরকে বলছেন, এ বছর এডিস মশা শনাক্তে চালানো জরিপে ঢাকায় মশার যে উপস্থিতি দেখা গেছে তা ঝুঁকিপূর্ণ। ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা করেছেন তারা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিলেন।