জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন
আমরণ অনশনের হুমকি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন
পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর দাবি আদায়ে টানা ১০ দিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকা সরগরম। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের একদফা দাবিতে তাদের এ আন্দোলন। সারা দেশ থেকে আসা শত শত শিক্ষক অনেকটা মানবেতরভাবে এখানে রাতদিন অবস্থান করছেন। রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে খেয়ে না খেয়ে জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগররা দাবি আদায়ের জন্য রাজপথকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো আশ্বাস পাননি। তাদের অনেকের আশা ছিল-শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তাদের কষ্টের কথা শুনবেন, বুঝবেন। অথচ কেউই তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং সরকারের তরফ থেকে অনেকটা সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যয় বাড়িয়ে এ রকম অযৌক্তিক দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়।
এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষকরা এমন কথা শুনতে নারাজ। তাদেরও সাফ কথা। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সঙ্গে সরকার পদে পদে অন্যায় ও বৈষম্য করে আসছে। এবার তারাও দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরে যাবেন না। শিক্ষামন্ত্রীর ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান। সাক্ষাৎ না পেলে এবং সুষ্ঠু সমাধান না হলে তারা আমরণ অনশনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, গত ১১ জুলাই থেকে তাদের এই কর্মসূচি চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝোলানোর কর্মসূচি চলছে ১৬ জুলাই থেকে। আন্দোলনের সপ্তম ও নবম দিনে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আলোচনার ডাক পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং ১৯ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু এসব বৈঠক থেকে তারা দাবিপূরণে কার্যকর কোনো আশ্বাস পাননি। তাই তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান। তারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললেই তাদের দাবি আদায় হয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি দাবি আদায়ে ইতিবাচক কিছু হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি আমাদের হতাশ করা হয় তাহলে আমরণ অনশনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে বিটিএ’র সাধারণ সম্পাদক বলেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ওপর শিক্ষক সমাজের কোনোদিনই আস্থা ছিল না। তিনি শিক্ষকদের মন্ত্রী নন। এ কারণেই এমন কথা বলতে পেরেছেন। শিক্ষকরা সাড়ে চার বছরে এই প্রথম শিক্ষামন্ত্রীর দেখা পেয়েছেন। তিনি শিক্ষকদের নিয়ে তাদের দাবির বিষয়ে বৈঠক করেছেন। কমিটি গঠনের কথাও বলেছেন। অথচ কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি রাখার আগ্রহ নেই। আসলে তিনি শিক্ষকদের কষ্ট বোঝেন না। তাই শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে শিক্ষকরাও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কোনো বাছবিচার ছাড়াই বলে দিলেন, নির্বাচনের আগে জাতীয়করণ সম্ভব নয়। এমনকি এও বলেছেন, কিসের ভিত্তিতে জাতীয়করণ করা হবে, সেটা পর্যালোচনা করতে হবে। আমাদের সাফ কথা, ৬শ স্কুল-কলেজ এই সরকার যার ভিত্তিতে জাতীয়করণ করেছে, সেটিই হবে এমপিওভুক্ত সাড়ে ৯ হাজার বিদ্যালয় জাতীয়করণের মানদণ্ড।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের দাবির প্রতি সরকার সহানুভূতিশীল। কিন্তু দাবি আদায়ে তারা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার পন্থা বেছে নিয়েছে। তাছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বই এখন মিতব্যয়িতার নীতি অনুসরণ করছে। এমন সময়ে হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির এই আন্দোলন কতটা যৌক্তিক সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। তারা শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সন্তুষ্ট না-ও হতে পারেন। কিন্তু তিনি সত্য কথা বলেছেন। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শিক্ষকদের বাড়ি পাঠানোর চেয়ে এমন সত্য কথা বলা অনেক ভালো।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষক আন্দোলনে অনেক সংগঠন আছে। প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলনকারীরা তাদের খুবই একটা ক্ষুদ্র অংশ। বুধবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সব শিক্ষক সংগঠন যোগ দেয়। তারা সবাই জাতীয়করণের ব্যাপারে দুটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব এবং নির্বাচনের পর কার্যক্রম শুরুর ব্যাপারে ‘কনভিন্সড’। বিটিএ নেতারাও সেখানে কনভিন্সড ছিলেন। কিন্তু পরে কেন তারা বেঁকে বসলেন সেটা বুঝতে পারছি না।’
আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষক নেতা যুগান্তরকে বলেন, সরকারি শিক্ষকরা যা পড়ান তারাও তাই পড়াচ্ছেন। নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই যোগ্যতা। তাহলে বেতন-ভাতা ও পেনশন ভিন্ন হবে কেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বেতন-ভাতার অনেক বৈষম্য আছে। বেতন কম দিয়ে তাদের চাকরি শুরু হয় এবং চাকরি শেষে তাদের তুলনায় সামান্য পয়সা দেওয়া হয়। তাও বছরের পর বছর হয়রানি করে। এসব কারণে তারা সারাজীবন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার মানেও। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার আগে বেতন-ভাতা প্রদানে সরকারকে স্মার্ট হতে হবে।
এদিকে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা জানান, চাকরিতে যোগদান থেকে শুরু করে অবসরজীবন পর্যন্ত পদে পদে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। একজন এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষক চাকরির শুরুতে ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান। কিন্তু সরকারি স্কুলে দেওয়া হয় ১৬ হাজার। তারা মূল বেতনের শতভাগ উৎসব-ভাতা (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায়) বা বোনাস পেলেও বেসরকারিতে দেওয়া হয় মাত্র ২৫ শতাংশ। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে সব চাকরিজীবী এমনকি এনজিও কর্মীদেরও শতভাগ উৎসব-ভাতা দেওয়া হয়। চিকিৎসা-ভাতা এক মাসে ৫০০ টাকা পান তারা। যেখানে একজন ডাক্তারের ভিজিট সর্বনিু ৬০০, ৮০০ বা ১০০০ টাকা, সেখানে একটি পরিবারকে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি শিক্ষকদের দেওয়া হয় দেড় হাজার। আবার বাড়িভাড়া বাবদ এক মাসে এক হাজার টাকা পান। কিন্তু সরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের ৪৫-৫০ শতাংশ দেওয়া হয়। তারা প্রশ্ন রাখেন, দেশের কোন অঞ্চলে এই টাকায় ভাড়া থাকা যায়?
শিক্ষক নেতারা আরও বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আরও অনেক ধরনের বৈষম্যের মধ্যে আছেন। তাদের কোনো বদলি নেই। অনেকে পরিবার এবং বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বহুদূরে চাকরি করছেন বছরের পর বছর। কিন্তু বদলি হয়ে নিজ এলাকায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এককালীন অবসর-ভাতা দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে চাকরি জীবনে অবসর খাতে ৬ শতাংশ ও কল্যাণ খাতে ৪ শতাংশ মিলিয়ে মোট ১০ শতাংশ বেতন থেকে কেটে রাখা হয়। অথচ অবসরে গেলে এককালীন কিছু টাকা পেতে ৪-৫ বছর লেগে যায়। এই টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না। অনেক শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর সময়মতো অবসরের টাকা না পেয়ে টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে পারেন না। খাওয়ার কষ্ট ছাড়াও রোগেশোকে মারা যান। বিপরীতে সরকারি শিক্ষকদের বেতন থেকে অবসর খাতে কোনো টাকা কাটা হয় না। এমনকি তারা অবসরে যাওয়ার পর যখন নিয়মানুযায়ী এককালীন পেনশন তুলে নেওয়ার পর মাসে মাসে যে অবসর ভাতা পান সেখানে চিকিৎসা বাবদ খরচও ভাতার সঙ্গে যুক্ত করা থাকে।
শিক্ষকরা আরও জানান, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ডিসিদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় আন্দোলন করা হয়েছে। কিন্তু সরকার বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের এসব কষ্ট বা দুর্দশার কথা আমলে নেয়নি। তাই এখন লাখ লাখ শিক্ষক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে প্রেস ক্লাবে জাতীয়করণের দাবিতে অবস্থান করছে। এখন একটাই দাবি জাতীয়করণ। জাতীয়করণ করলে শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি-বেসরকারি কোনো বৈষম্য আর থাকবে না।
আন্দোলনের দশম দিনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই প্রেস ক্লাবের সামনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা তাদের দাবি আদায়ের কর্মসূচি শুরু করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষক নেতারা শিক্ষামন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। তারা বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী ডাক্তার হয়েও মানুষের সেবা করেন না। ঘটনাক্রমেই তিনি রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তিনি ঘটনাক্রমেই একবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। সেখানে সফল হতে পারেননি। আবার সরকারের এই আমলে ঘটনাক্রমেই তিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। কাজেই শিক্ষকদের দুঃখ-দুর্দশা তিনি কীভাবে বুঝবেন। কিন্তু আমরা শিক্ষকরা ঘটনাক্রমে শিক্ষক হইনি। আমরা শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে অনেক ভালো চাকরি না করেও শিক্ষকতায় এসেছি। ভেবেছিলাম, এখানে সম্মান আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পেটের দায়ে আমাদের আজ রাস্তায় দাঁড়াতে হয়েছে। আমরা সরকারপ্রধানের কাছে আমাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি পূরণের জন্য জোরালো আহ্বান রাখছি।’