কূটনীতি-রাজনীতিতে ঝড়ো হাওয়া
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উজরা জেয়ার বৈঠকের প্রতি সবার দৃষ্টি * সফররত ইইউ প্রতিনিধিদলের সামনে বিক্ষোভ
মাসুদ করিম
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নির্বাচন নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে রাজনীতিতে বইছে ঝড়ো হাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ প্রতিনিধিদলের তৎপরতা দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে শক্তিশালী মার্কিন প্রতিনিধিদল মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশে কিভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে সে বিষয়ে দৃশ্যত তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রতিনিধিদলের নেতার বৈঠক হবে। এ বৈঠকের দিকেই দৃষ্টি থাকবে সবার। বিএনপির সঙ্গেও তারা বৈঠক করবে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুসন্ধানী মিশন কাজ শুরু করেছে আগেই। মঙ্গলবার দলটির সামনে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বিক্ষোভ করেন। বিদেশিদের আগমনের সময় টার্গেট করে আগেভাগেই আজ সরকার পতনের একদফা আন্দোলন ঘোষণা করতে যাচ্ছে বিএনপি। একই দিনে বিরোধীদের মোকাবিলায় শান্তি সমাবেশ নিয়ে মাঠে থাকছে আওয়ামী লীগ।
হঠাৎ রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র কৌতূহল, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশে কূটনীতি ও রাজনীতিতে ঝড় শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এই ঝড়ের শেষ কোথায়। তারা জানতে চান, এবারই সংকটের সমাধান হবে না আরও বড় ঝড় উঠবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন মার্কিন প্রতিনিধিদের এ সফরে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে আসতে পারে। তবে এ ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ককেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে দেশটির প্রতিনিধিদল ভারত সফর শেষ করে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। প্রতিনিধিদলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি’র ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলী কৌর অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। দলটি ঢাকায় পৌঁছেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এর আগে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার সঙ্গে উজরার বৈঠকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো তালিম দেওয়া হয়েছে কিনা তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে। যদিও মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠেছিল কিনা তা স্পষ্ট হয়নি। মে মাসে বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করলে রাজনীতিতে হইচই পড়ে যায়। অন্যদিকে এ ইস্যুতে রাশিয়া, চীন ও ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভিন্ন। তারা মনে করেন নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
বিদেশিদের দেখাতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শক্তি প্রদর্শন চলছে। রাজনৈতিক সূত্রমতে, বিএনপি ১৫ জুলাই একদফার ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দুই প্রতিনিধিদলের আগমন উপলক্ষ্যে তারা কর্মসূচি এগিয়ে আনে। বিদেশিদের দেখে বিএনপিকর্মীদের মধ্যে চাঙা ভাব বিরাজ করছে। তারা ভাবছে, সরকার এখন তাদের কর্মসূচিতে বাধা দিতে পারবে না। আওয়ামী লীগও শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ঢাকার রাজপথে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে।
একই দিনে দুটি সমাবেশই শুধু নয়; বিদেশিরা যেখানে যাচ্ছেন সেখানেও বিক্ষোভ প্রদর্শন হচ্ছে। দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখানো হচ্ছে। মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক করতে ইইউ প্রতিনিধিদল গিয়েছিল। সেখানে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বিক্ষোভ করেছেন। তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, ডেমোক্রেসি’ লেখা ফেস্টুন প্রদর্শন করেন। দুই বড় দল রাজপথে থাকায় পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। উজরা জেয়ার প্রতিনিধিদলের আগমন লগ্নে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। যুক্তরাষ্ট্র শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। এদিকে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে একই সঙ্গে বড় শোডাউনের কর্মসূচি দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ঢাকায় মার্কিন নাগরিকদের জন্যে সতর্কতা জারি করেছে।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম শফিউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, দুপক্ষ মুখোমুখি হওয়ায় সংকট সুরাহার দিকে যাচ্ছে না। সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ’র পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশও যথেষ্ট সক্রিয়। তারা স্থিতাবস্থার কথা বলছেন। তিনি আরও বলেন, সংঘাতের মাধ্যমে কোনো সমাধান আসে না। সংঘাত গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নতিকে ব্যাহত করবে। উভয়পক্ষকে রাজনৈতিক সমাধান কীভাবে হবে সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে সংলাপ করতে হবে। সাবেক এ কূটনীতিক আরও মনে করেন, নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে না। তবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের শঙ্কা আছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে বাইডেনের কাছে ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান চিঠি দিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবৃতি দিয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যও সরকারের মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনা করে ইইউ পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতিবিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধিকে চিঠি দিয়েছেন। ইইউ অনুসন্ধানী মিশন দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান করে সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, মিডিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে ইইউ নির্বাচনি পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ইইউ আগেই বলেছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। তবে রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে বলে ইইউ মনে করে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতেও পারে।
পশ্চিমাদের এমন চাপের মধ্যে এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তন করে। সেন্টমার্টিন দিয়ে দিলে ক্ষমতায় থাকতে পারেন। কিন্তু ক্ষমতার জন্যে তিনি সার্বভৌমত্ব বিক্রি করবেন না। রাজনীতিবিদরা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যাপারে সমালোচনামুখর হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সতর্ক ও নমনীয়।
উজরা মিশনের প্রতি সবার দৃষ্টি : উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরকে ঘিরে কৌতূহল উপচে পড়ছে। আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের হার্ডলাইন অবস্থার মধ্যে প্রতিনিধিদলের আগমন। প্রতিনিধিদলে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অপসারণের জন্য ডোনাল্ড লুকে দায়ী করেছেন তিনি। আলোচিত এ কূটনীতিক কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তাছাড়া, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ভিসানীতি ঘোষণা করার সময়েও মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়ে তার ব্যাখ্যা দেন ডোনাল্ড লু। উজরা মিশনের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হচ্ছে। এই বৈঠকের দিকেই আগ্রহ বেশি। কারণ বর্তমান সংকটে অনেক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক পর্যায় থেকে হতে হবে। বিএনপির সঙ্গে বৈঠকেও কী আলোচনা হয় সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশে অতীতে কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় তেমন কোনো সাফল্য আসেনি। উজরা জেয়ার মিশন যদিও মধ্যস্থতার নয়; তবে তার তৎপরতার ফলে রাজনৈতিক সংকটের কতটা সমাধান সম্ভব সেটা এখন দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে উজরা মিশনের বৈঠক হবে। এসব বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিদলের তরফে যেসব প্রশ্ন আসতে পার তার জবাবের প্রস্তুতি রেখেছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় একটি বৈঠক হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন পদ্ধতি, মানবাধিকার, শ্রমঅধিকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, উপাত্ত সুরক্ষা আইন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের প্রত্যাশা আগেই ব্যক্ত করেছে। নির্বাচনে কোনো সহিসংতা যাতে না হয় সে ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বারোপ করছে।