সমবায় অধিদপ্তরে ৫১১ পদে নিয়োগ
শতকোটি টাকা বাণিজ্যে মরিয়া সিন্ডিকেট
অবৈধ নিয়োগ কমিটির অধীনে এমসিকিউ পরীক্ষা * তথ্য গোপন করে ছাড়পত্রের মেয়াদ বৃদ্ধি
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সমবায় অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫১১টি পদে কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এই নিয়োগ ঘিরে শতকোটি টাকা বাণিজ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ চক্রের নেপথ্যে আছেন এক মন্ত্রীর ছেলে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অবৈধ নিয়োগ কমিটির অধীনে সম্পন্ন করা হয়েছে এমসিকিউ পরীক্ষা। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ বা পরিপত্রও মানা হচ্ছে না।
চক্রটি টার্গেটকৃত চাকরিপ্রার্থীর তালিকা করে তাদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ কোটি টাকা তুলেছে। আরও টাকা তোলার টার্গেট রয়েছে। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু দালিলিক প্রমাণসহ অভিযোগ গড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। একাধিক সূত্রে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য মিলেছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ১৫ মার্চ সমবায় অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫১১টি শূন্য পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
এই নিয়োগের ছাড়পত্রের বৈধ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২৮ জুন। এর মধ্যেই নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তারা মে ও জুনে চার ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে প্রাথমিক পর্যায়ে এমসিকিউ পরীক্ষা নিয়েছে। এরই মধ্যে ২৮ জুনের মেয়াদ পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বাকি ধাপগুলো শেষ করে কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী ছাড়পত্রের মেয়াদ ফের বাড়ানোর সুযোগও নেই। এরপরও সিন্ডিকেট সদস্যরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই নিয়োগ সম্পন্ন করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. তরুণ কান্তি শিকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সবকিছু আইনসংগতভাবেই করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ছাড়া আমরা কিছুই করিনি। ছাড়পত্রের মেয়াদ ১ বছর ছিল, সেটা বাড়িয়ে আড়াই বছর করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর পর সেটা না দিতে পারলে তো হয় না। এর মধ্যে ত্রুটিবিচ্যুতি যেগুলো হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো আইনগতভাবে মেনে নিয়েই আমরা কাজ করেছি।’
ঘুস লেনদেনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার নাম তরুণ কান্তি। আর বাবলা দাশ যেহেতু হিন্দু, তাই তার সঙ্গে আমাকে জড়ানো খুবই সহজ। আসলে বাবলা দাশকে আমি চিনি না। তার নাম শুধু শুনি আর টেলিভিশনে চেহারা দেখি। পরে একদিন ডেকে বলেছিলাম, তোমার নামে এত অভিযোগ কেন? পরে তাকে এখান থেকে বদলি করে দিয়েছি। তারপরও যদি মানুষ বাবলা দাশকে ঘুস দেয়, তারা যদি মনে করে বাবলা দাশকে টাকা দিলে চাকরি পাওয়া যাবে, তাহলে আমার কী করার আছে?’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। নিয়োগ কমিটির সদস্যরা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেছে, এখনো করছে।’
জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী সমবায় অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক/সভাপতি হবেন অতিরিক্ত নিবন্ধক (প্রশাসন, মাসউ ও ফাইন্যান্স)। কিন্তু সমবায় অধিদপ্তরে এই পদে বর্তমানে কেউ কর্মরত নেই। চলমান নিয়োগ বাণিজ্য কবজা করতে এই পদে কাউকে পদায়ন না করে অবৈধভাবে যুগ্মনিবন্ধক হাফিজুল হায়দারকে এই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তরুণ কান্তি শিকদার নিজের লোক হিসাবে ২২ জানুয়ারি তাকে অধিদপ্তরের যগ্মনিবন্ধক (সেবা শিল্প) হিসাবে পদায়ন করেন। একই সঙ্গে তাকে অতিরিক্ত নিবন্ধক (প্রশাসন, মাইস ও ফাইন্যান্স) পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ এ সময় অধিদপ্তরে অতিরিক্ত নিবন্ধক পদমর্যাদার দুইজন সিনিয়র কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন। তাদের ওই পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কাউকে ঊর্ধ্বতন পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যায় না।
জানতে চাইলে নিয়োগ কমিটির প্রধান যুগ্মনিবন্ধক হাফিজুল হায়দার বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের প্র্যাকটিস আছে। এটা অবৈধ নয়। আর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের বাণিজ্যের সুযোগ নেই। সব অভিযোগ বানোয়াট। নিয়োগ কমিটিতে সমবায় অধিদপ্তরের দুজন আর বাকি তিনজনই বাইরের। কাজেই এখানে আমাদের ইচ্ছামতো কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৮ জুন নিয়োগের ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা জেনেও তড়িঘড়ি এমসিকিউ পরীক্ষা নিয়ে কেন্দ্র ফি, প্রশ্ন ও উত্তরপত্র তৈরি, মূল্যায়নসহ অন্যান্য ব্যয় দেখিয়ে সরকারি কোষাগারের প্রায় ৫ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন চক্রের সদস্যরা।
জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের ১৯ অক্টোরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এই নিয়োগের ছাড়পত্রের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১ বছর বাড়ানো যাবে বলে নির্দেশনা ছিল। সে মোতাবেক গত বছরের ২২ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ছাড়পত্রের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২৮ জুন নির্ধারণ করা হয়েছিল। অথচ সংস্থাটির ডিজি দাবি করেন, মেয়াদ আড়াই বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ছাড়পত্রের মেয়াদ বাড়ানোর ফাইলে ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া দরকার’-বলে নোট দেন। পরে প্রভাবশালীদের চাপে ওই নোট ছিঁড়ে ফেলা হয়। এরপর এক বছরের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি গোপন রেখে নতুন করে ছাড়পত্রের সময় বাড়ানোর জন্য ফাইল অগ্রগামী করে সময় বাড়ানো হয়। এই তথ্য গোপনের বিষয়টি শুধু নিয়মবহির্ভূত নয়, অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জানা যায়, সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত। এই গোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন এবং তাদের চ্যানেলের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
অভিযোগ আছে, জনপ্রতি ১২ থেকে ২০ লাখ টাকা করে ঘুস আদায় করেছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। দেনদরবারে থাকা সম্ভাব্য চাকরিপ্রার্থীদের এই তালিকাও এসেছে যুগান্তরের হাতে। অভিযোগ আছে, এরই মধ্যে প্রার্থীদের কাছ থেকে অন্তত ৬০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। এই টাকা ‘হালাল’ করতে সরকারের শেষ সময়ে নিয়ম ভেঙে হলেও নিয়োগ সম্পন্ন করতে চান সিন্ডিকেট সদস্যরা।
চাকরিপ্রার্থী ও সমবায় অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ১৯ ও ২৬ মে এবং ২ জুন তৃতীয় শ্রেণির ও ৯ জুন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের এমসিকিউ পরীক্ষার প্রতিটিতেই অনিয়মের অভিযোগ ছিল। কিন্তু নিয়োগ কমিটি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অভিযোগ আছে, ১৯ মে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র খোলা অবস্থায় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। পরীক্ষার দিনই কন্ট্রোল রুমে এ নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল।
৯ জুন অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় সরকারি বাঙলা কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে ২ জন পরীক্ষার্থী হাতে লেখা প্রশ্নসহ ধরা পড়ে। বিষয়টি গোপন রেখে পরীক্ষা চালিয়ে যায় সংশ্লিষ্টরা। একই দিনে মিরপুর ডেভেলপমেন্ট মডেল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড কলেজসহ একাধিক কেন্দ্রে ভুয়া পরীক্ষার্থী ধরা পড়ে।
এছাড়া যেখানে এমসিকিউ পরীক্ষার ফলাফল পরদিন প্রকাশ করা যায়, সেখানে দুই সপ্তাহ পর তারা ফলাফল দেয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির এমসিকিউ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় ২/৩ দিনের মধ্যেই।
অথচ চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে দেনদরবার চূড়ান্ত করতে গিয়ে এই পরীক্ষার ফল প্রকাশে কালক্ষেপণ করা হয়। জানা যায়, ঘুসের বিনিময়ে যাদের চাকরি দেওয়ার দেনদরবার চলছে, ওই তালিকার অন্তত ৭০ জন আছেন যারা বিশেষ ঘরানার সদস্য।