জনতার কাঠগড়ায় জনপ্রতিনিধি: মৌলভীবাজার-১ আসন
স্বজনদের ত্রাসের রাজত্ব মন্ত্রীর আশকারায়
ছেলে, ভাগিনা ও ভাইদের ইশারায় চলে প্রশাসন
মাহবুবুর রহমান রিপন, সিলেট
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মৌলভীবাজার-১ আসনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের আশকারায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন তার স্বজনরা। মন্ত্রীর ছেলে, ভাগিনা আর খালাতো ভাইদের ইশারা ছাড়া প্রশাসন কিংবা থানায় কোনো কাজই হয় না। স্বজনদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ীর মানুষ।
টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলাসহ তাদের আধিপত্য সবখানে। তাদের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে মন্ত্রীবাহিনী। আর এ বাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হচ্ছেন খোদ দলীয় নেতাকর্মীও। তাদের ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারও।
মো. শাহাব উদ্দিন ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত টানা ১০ বছর জাতীয় সংসদ-সদস্য এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তার ১৫ বছরের মেয়াদে নির্বাচনি এলাকা কিংবা জেলায় হয়নি দৃশ্যমান উন্নয়ন। বরং নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি ও তার স্বজনরা। বাবা মন্ত্রী হওয়ার পরই জাকির হোসেন জুমন লন্ডন থেকে দেশে চলে আসেন।
ঢাকায় মন্ত্রীর বাসায় থেকে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। মাঝেমধ্যে জুড়ী-বড়লেখায় গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে নিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া দেন। নেতাকর্মীবেষ্টিত হয়ে পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে এলাকায় ঘোরেন এমন অভিযোগ সর্বত্র। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় প্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নেন।
আবার নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গোপনে প্রশাসনের সহযোগিতায় বিজয়ী করার কথা বলে তাদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নেন কয়েক লাখ টাকা। নির্বাচনে কয়েক প্রার্থীকে বিজয়ী করতে না পারায় তাদের কারও টাকা ফেরত দিয়েছেন। এখনো অনেকে টাকা ফেরত চাইতে সাহস পান না।
২০২১ সালের দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জুড়ীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়। ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টিতেই হেরেছেন নৌকার প্রার্থীরা।
জুড়ীর গোয়াল বাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের নৌকার পরাজিত প্রার্থী শাহাব উদ্দিন লেমন বলেন, আমি উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান রিংকু রঞ্জন দাস ও তৎকালীন জেলা পরিষদ সদস্য শিমুলের মধ্যস্থতায় মন্ত্রীর ছেলে জুমনকে ৭ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। বিজয়ী করতে না পারায় টাকা ফেরত চাইলে তিনি টাকা দেননি। বিষয়টি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানাই। শেষ পর্যন্ত গত মাসে মন্ত্রী আমাকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা কয়েক দিনের মধ্যে দেবেন বলেছেন। পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাদির ভাইকে ১৫ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন। তার ৫ লাখ টাকা এখনো রয়েছে। পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নে নৌকার পরাজিত প্রার্থী আব্দুল কাদির বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা টাকা দিয়ে প্রশাসন কিনে নিয়েছে। টাকা লেনদেনের সঙ্গে কে জড়িত ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুনেছি মন্ত্রীর ছেলে জুমন ছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, জুড়ীর দক্ষিণ সীমানা থেকে বড়লেখার উত্তর সীমানা চান্দগ্রাম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সওজ রাস্তার পাশে ৩৭৩টি সোলার স্ট্রিট লাইট (৩০ ওয়াটের) স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়। সরেজমিন পাওয়া যায় বড়লেখায় ১৮০টি আর জুড়ীতে ১২৩টি। বাকি ৭০টির হিসাব নেই। এ প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এমপির মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট’। প্রকল্পের বাজেট ছিল ৫ কোটি টাকা। কিন্তু এ প্রকল্পে সাগর চুরির অভিযোগ আছে। নগরবিদদের মতে, এরকম সৌরবাতি লাগাতে খরচ হয় ৩০-৪০ হাজার টাকা। কিন্তু এ প্রকল্পে একেকটা বাতির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সরেজমিন ২৮ কিলোমিটার ঘুরে দেখা যায়, ইতোমধ্যে অনেক বাতিই জ্বলছে না। এ কাজের তদারকিতেও নাকি ছিলেন মন্ত্রীর ছেলে জুমন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মন্ত্রীর ভাগিনা বড়লেখা উপজেলা চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ উপজেলাজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তার কথা ছাড়া উপজেলা প্রশাসন কিংবা থানা কেউই কাজ করতে পারে না। নাম গোপন রাখার শর্তে এক আওয়ামী লীগ নেতা (অডিও রেকর্ড সংরক্ষিত আছে) বলেন, এমন কোনো অপরাধ নেই উপজেলা চেয়ারম্যান করেন না। উপজেলার সব সিন্ডিকেটের নায়ক তিনি। তার বিরুদ্ধে দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউপির চেয়ারম্যান আজির উদ্দিনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতের অভিযোগ রয়েছে।
২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল দুপুরে আজির উদ্দিনসহ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদের কার্যালয়ে যান। এ সময় আজির উদ্দিন হাটবাজার থেকে রাজস্ব খাতের আয়ের টাকা না পাওয়ার কারণ জানতে চাওয়ায় সোয়েব আহমদ ক্ষেপে যান। একপর্যায়ে তিনি আজির উদ্দিনকে জুতাপেটা করেন। বড়লেখা সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন বলেন, এখানে গণতন্ত্রের পরিবর্তে পরিবারতন্ত্র চলছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। আমরা দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজনীতি করে আসছি। দলের জন্য অনেক ত্যাগ করেছি। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো সংকট কখনো দেখা যায়নি।
২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা ও জেলা থেকে দলীয় প্রার্থী হিসাবে ১ নম্বরে আমার নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে আমাকে বাদ দিয়ে মন্ত্রীর ভাগিনা ছালেহ আহমদ জুয়েলকে নৌকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হই। নির্বাচন না করার জন্য আমাকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে আমি মনোনয়নপত্র জমা দিলে তা প্রত্যাহারের জন্য বড়লেখা থানার ওসিকে দিয়ে আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়।
জুড়ী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী মনি বলেন, ২ জুন দিনরাত মিলিয়ে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল। রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় ছেলেমেয়েদের ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের কাউকে ফোনে না পেয়ে একপর্যায়ে গরমে অসহ্য হয়ে মন্ত্রীর খালাতো ভাই আহমদ কামাল অহিদকে ফোন দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করি। তখন তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। পরের দিন সকালে তিনি ২৫-৩০ জন লোক নিয়ে আমার বাসায় হামলা করেন। বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ, উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি।
জুড়ীর কলাবাড়িতে অবস্থিত মেসার্স শাহ জালাল করাতকলের স্বত্বাধিকারী আব্দুল লতিফ বলেন, মন্ত্রীর খালাতো ভাই আহমদ ফয়ছাল নাহিদ শেয়ারে কাগজপত্র করে দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন। দুবছর টাকা রেখে কাগজ করে দিতে না পেরে ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেন। পরে মামলা দিয়ে করাতকলের বিরুদ্ধে স্টে-অর্ডার করে রাখেন। একপর্যায়ে তিনি করাতকলের শেয়ার দাবি করেন। তিনি দাবি করেন, এ করাতকলের জন্য মন্ত্রীর পিএসকে দেড় লাখ টাকা, মন্ত্রণালয়ে ১ লাখ টাকা, রেঞ্জার ও ফরেস্টারসহ ৭ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। পরে বিষয়টি সমাধানের জন্য দুবার সালিশে বসা হয়। কিন্তু সমাধান হয়নি। সালিশে উপস্থিত ছিলেন ইউপি সদস্য আখলিছ, হারিছ ও জুয়েল। পরে নাহিদ থানায় আমার ও আমার ভাই সাব্বির আহমদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। থানাও আমাকে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।
২০২১ সালের ১৫ জুন রাতে জুড়ীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক উপকমিটির সদস্য এসএম জাকির হোসাইনের গাড়িতে হামলা করা হয়। এ বিষয়ে জাকির হোসাইন বনমন্ত্রীর খালাতো ভাই, উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি আহমদ কামাল অহিদের নেতৃত্বে আরিফ আহমদ, তার ভাই সাহেলকে অভিযুক্ত করেন।
মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মন্ত্রী এবং তার অনুসারীরা। অনেকে বন পুড়িয়েও দখলে নিচ্ছেন। আবার কেউ বন থেকে সরকারি গাছ কাটছেন। চলতি বছর জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে উপজেলার সংগঠন নাইট চৌমুহনীতে মানববন্ধনের আয়োজন করে।
মন্ত্রীর অনুসারী, পুলিশ প্রশাসন ও ভূমি-বন দখলদারদের কারণে ওই সংগঠনের কর্মীরা মানববন্ধন করতে পারেননি। মানববন্ধনের উদ্যোক্তা নোমান হোসাইন বলেন, দেশ, মানুষ এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য আমরা মানববন্ধনের ডাক দিই। কিন্তু মন্ত্রীর অনুসারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং পুলিশ প্রশাসনের চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত আমরা মানববন্ধনই করতে পারিনি।
অভিযোগের বিষয়ে সোয়েব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, মন্ত্রী তার মামা হলেও তিনি কোথাও কোানা প্রভাব বিস্তার করেন না। রাজনৈতিক কারণে এসব অভিযোগ করছেন কেউ কেউ।
ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিজয়ী করতে টাকা নেওয়া ও পরে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে জাকির হোসেন জুমন বলেন, তিনি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি। কেউই তার সামনে এসে বলতে পারবে না। ঢাকার বাসায় নিয়ে টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবা এমন অভিযোগ শোনার পরই যাদের কাছে বিজয়ী হতে টাকা দিয়েছিলেন প্রার্থীরা তাদের ঢাকার বাসায় ডেকে নিয়েছেন। প্রার্থীদের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করেছেন। আমি টাকা নিয়েছি বাবার কাছে কেউ এমন অভিযোগ করেনি।
বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, আমার কাছে তো কেউ কোনো দিন এসব অভিযোগ করেনি। সামনে নির্বাচন। জুড়ী থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ আসনে প্রার্থী হতে চান। তিনি তার লোকজন দিয়ে এসব অভিযোগ তুলছেন। উদ্দেশ্য আমাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় করা। তিনি বলেন, প্রায় চার যুগ ধরে রাজনীতি করছি। কেউ কখনো কোনো অভিযোগ তুলতে পারেনি। এখন এ বয়সে এসে এমন কথাবার্তা শুনলে খুব কষ্ট হয়।