কুরবানির পশু কেনাবেচা
হাটে ঘাটে রাস্তায় নীরব চাঁদাবাজি
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুলিশ প্রশাসনের কঠোর নির্দেশনার পরও কুরবানি পশুর হাট এবং পশুবাহী ট্রাকে নীরব চাঁদাবাজি হচ্ছে। কতিপয় অসাধু পুলিশ সদস্য ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা বেপারিরা প্রতিনিয়ত তাদের খপ্পরে পড়ছেন। তবে অনেকেই মুখ খুলছেন না। ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীদের অনেকেই বলছেন, পথে পথে চাঁদার টাকা না দিলে গরু আরও কম দামে বিক্রি করতে পারত।
এদিকে, এবার পশুর হাট ও সড়কে কোনো চাঁদাবাজি নেই বলে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এর এক সপ্তাহের তথ্য অনেকেই ভাবিয়ে তুলেছে। ২০ জুন থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত সাতদিনে ৯৯৯ এ ২৮২টি কল এসেছে। এরমধ্যে রাস্তা থেকে গরুর ট্রাক হাটে জোর করে ঢোকানোর ১১১টি অভিযোগ, গরুর হাটে চাঁদাবাজির ৬৬টি, পথে পশুর ট্রাকে চাঁদাবাজির ২৬টি, নদীপথে চাঁদাবাজির আটটি অভিযোগ এসেছে। এছাড়া অন্য বিষয়ে ৫৬টি এবং অজ্ঞানপার্টির ১১টি এবং জালনোটের চারটি অভিযোগ এসেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-এসব অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকার বেরাইদ এলাকায় ১০০ ফিট গরুর হাটে দিনাজপুরের বিরামপুর থেকে গরু নিয়ে এসেছেন ট্রাকচালক জুলফিকার। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ হাটে সোমবার রাতে তিনি গরু নিয়ে এসেছেন। পথে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে নওগাঁর মহাদেবপুর থেকে ১৮টি গরু নিয়ে রওয়ানা দিয়ে ২০ জুন রাত সাড়ে ৩টায় ঢাকা তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন। শুক্রাবাদ এলাকায় লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে ট্রাকের গতি রোধ করে একদল দুর্বৃত্ত গরু ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তারা বেপারি আজাদ হোসেনসহ আমাকে মারধর এবং ট্রাক ভাঙচুর করে। নগদ ৫ হাজার টাকাও ছিনিয়ে নেয়। এ সময় টহল পুলিশ মোহাম্মদ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মারুফুল ইসলাম বিপ্লবসহ পাঁচজনকে আটক করে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যায় বছিলা হাটে গরু নিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা উদ্যান ৩ নম্বর রোড এলাকায় দুর্বৃত্তরা শাকিল আহমেদ সেন্টুকে (৩২) কুপিয়ে গুরুতর আহত করে একটি গরু নিয়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন সেন্টু। তার বড় ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে থানায় মামলা হয়েছে।
বুধবার গাবতলী পশুর হাট, দিয়াবাড়ি হাট, আফতাব নগর হাটসহ বিভিন্ন হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে-প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে নিয়ম অনুসারে হাসিল আদায় করা হচ্ছে। তবে ক্রেতাদের গরু বহনকারী একাধিক ট্রাক চালক যুগান্তরকে অভিযোগ করেন, পশুর হাটে ভলান্টিয়ার হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের ট্রাকপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। টাকা না দিলে তারা সড়কে বিশৃঙ্খলার অজুহাত দেখিয়ে গরু পরিবহণে বাধা দেয়।
উত্তরার দিয়াবাড়ি পশুর হাটে ট্রাক চালক আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, তিনি সোমবার কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে এক ট্রাক গরু নিয়ে এ হাটে এসেছেন। পথে চারটি স্থানে তাকে চাঁদা গুনতে হয়েছে। ঢাকায় আসার আগে কুষ্টিয়ার লালন ব্রিজ এলাকায় এক পুলিশ সদস্যকে দেড় হাজার টাকা, আরও দুই স্থানে ১ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। আরেকটি স্থানে ৫০০ টাকা গুনতে হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েকজন তার ট্রাকটি আশুলিয়া বাজারে ঢোকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ থাকায় তারা পারেনি।
রংপুরের ট্রাক চালক আমজাদ আলী যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় আসার পথে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও আশুলিয়ায় হাইওয়ে পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে পথ রোধ করে চাঁদা নিয়েছে। খিলক্ষেত ডুমনি হাটে রাজশাহী থেকে গরু নিয়ে আসা সিরাজউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের গোড়াই এলাকায় হাইওয়ে পুলিশ এবং কয়েকজন যুবককে চাঁদা দিতে হয়েছে। কোথাও এক হাজার টাকা, কোথাও ৫০০ আবার কোথাও দেড় হাজার টাকা দিয়ে আসতে হয়েছে।
গরুর পাইকার ও খামারিরা অভিযোগ করেন, সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন উত্তরাঞ্চল থেকে গরু নিয়ে আসা লোকজন। কদমতলীর ট্রাক মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, উত্তরাঞ্চল থেকে ট্রাক নিয়ে আসার সময় হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয় থাকা চাঁদাবাজদের খপ্পরে পড়েন পশুবাহী ট্রাক চালকরা। তিনি বলেন, আগের চেয়ে পুলিশ অনেকটাই সতর্ক। এ কারণে অন্য বছরের তুলনায় সড়কে চাঁদাবাজি অনেকটাই সহনীয়।
পশুর ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। এরপরও কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে এবং কেউ অভিযোগ করলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
র্যাবের লিগ্যাল মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, গত রোববার গাবতলী-সাভার রোডে অভিযান চালিয়ে গরু ছিনতাই ও গরু নিয়েও টাকা না দেওয়ার অভিযোগে ২১ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়াও হাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধ রুখতে র্যাব সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। হাটে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, প্রতারকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।