Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বরগুনা-১ : বরগুনা-আমতলী-তালতলী

এমপি হলেই অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠেন শম্ভু

জনতার কাঠগড়ায় জনপ্রতিনিধি : সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, ছেলে সুনাম দেবনাথকে মাদক বাণিজ্যে সহায়তার অভিযোগ

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এমপি হলেই অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠেন শম্ভু

সংসদ-সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। ফাইল ছবি

যতবার সংসদ-সদস্য (এমপি) হয়েছেন, ততবারই অর্থবিত্তে আরও ফুলেফেঁপে উঠেছেন ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তিনি বরগুনা-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য। টানা ৩০ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে থাকা শম্ভু কেবল নিজে নন, পরিবারের সবাইকে নিয়েই দলকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। 

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ, উন্নয়ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ আর একমাত্র ছেলে সুনাম দেবনাথকে মাদক বাণিজ্যে সহায়তা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই মাদক আবার বিশাল ভূমিকা রাখে বরগুনার স্থানীয় রাজনীতিতে। কাবিখা-কাবিটার মতো বরগুনায় খুব প্রচলিত একটা শব্দ হচ্ছে ‘মাবিরা’, যার অর্থ ‘মাদকের বিনিময়ে রাজনীতি’। 

এই মাদক ধ্বংস করে দিচ্ছে বরগুনার কিশোর, তরুণ আর যুবকদের। এসব বিষয় নিয়ে বহুবার প্রতিবাদ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানো হয়েছে দফায় দফায় লিখিত অভিযোগ। সংবাদ সম্মেলন হয়েছে সুনামের মাদক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে। বরগুনায় অবাঞ্ছিত পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে সংসদ-সদস্য শম্ভুকে।

এরপরও কিছুই হয়নি। এখন চলছে তার দলীয় মনোনয়নে ষষ্ঠবারের মতো সংসদ-সদস্য হওয়ার প্রস্তুতি। কেন্দ্রসহ বিভিন্ন পর্যায়ে এজন্য লবিং-তদবিরও করছেন তিনি। 

যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান, দলীয় নেতাকর্মী এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। যদিও এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি সংসদ-সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে কোন্দলের জেরে তার বিরুদ্ধে সব সময় সক্রিয় একটি চক্র এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে পালটা অভিযোগ তার।

যত সম্পদ : শুধু হলফনামার হিসাবেই ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে সংসদ-সদস্য শম্ভুর সম্পদ। এই সময়ে তার স্ত্রীর সম্পদও বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ। যদিও বাস্তবে আরও বেশি সম্পদের মালিক তিনি-এমনই অভিযোগ বরগুনার বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় ২১ লাখ ১১ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন শম্ভু। এছাড়া বরগুনা শহরের হাইস্কুল সড়কে ৩.২০ শতক জমির ওপর একতলা বাড়ি, দুটি টিনের ঘর, দশমিক ২০ একর অকৃষি জমি, ব্যাংকে ৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জমা দেখান তিনি। স্ত্রীর নামে ঢাকার গুলশানে ২৯ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে ১২ লাখ টাকা আমানত দেখানো হয় ওই হলফনামায়। 

২০১৪তে এসে দেখা যায়, একলাফে ২১ লাখ থেকে বেড়ে তার অস্থাবর সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ৯৯ হাজার। স্ত্রীর মোট সম্পদের পরিমাণ ৪১ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬ লাখ টাকা।

ওই নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় নিজের নামে একটি ল্যান্ড ক্রুজার আর একটি টয়োটা গাড়িও দেখান শম্ভু। সেই সঙ্গে দেখানো হয় একটি শটগান এবং একটি পিস্তলের মালিকানা। অকৃষি জমি বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন আরেকটি বাড়ির মালিকানার কথাও উল্লেখ করা হয় ২০১৪-এর হলফনামায়।

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় আরেকবার উপরের দিকে লাফ দেয় শম্ভুর সম্পদ আর বিত্ত। এবার তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় ২ কোটি ১৩ লাখ ৯১ হাজার ১৯০ টাকা। যার মধ্যে নগদ টাকার পরিমাণ দেড় কোটির বেশি। 

অথচ ২০০৮-এর হলফনামায় ব্যাংকে মাত্র ৯ লাখ টাকা থাকার কথা বলেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ২০১৪-এর তুলনায় সব সেক্টরেই বাড়তি দেখানো হয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। তিনটি জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দাখিল করা এসব হলফনামায় নিজের আয় হিসাবে পরামর্শক, সংসদ-সদস্য হিসাবে বেতনভাতা এবং স্ত্রীর ব্যবসাকে দেখানো হলেও আইনজীবী হিসাবে শম্ভুকে যেমন খুব একটা দেখা যায়নি আদালতে, তেমনই তার স্ত্রীর ব্যবসার বিষয়টিও আগাগোড়া রয়েছে অন্ধকারে। তবে প্রতিবারই নিজস্ব আয়ের অঙ্ক বাড়িয়েছেন শম্ভু। 

২০১৪তে যেখানে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ২৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, সেখানে ২০১৮তে ৪৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা দেখান তিনি। হলফনামার হিসাবেই ১০ বছরে ১০ গুণ সম্পদের মালিক হওয়া শম্ভুর আরও সম্পদ রয়েছে, যার উল্লেখ নেই কোথাও।

এসব সম্পদের প্রায় পুরোটাই করেছেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও বেনামে-এমন অভিযোগ করে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেন, ‘রাজধানীর গুলশানে ৩ হাজার ৩০০ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে শম্ভুর। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং প্রীয়প্রাঙ্গণে রয়েছে স্ত্রী-কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ৪টি প্লট। ১ হাজার ৩০০ বর্গফুট আয়তনের ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে মধ্য বাড্ডায়। নিজেরসহ স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের নামে রয়েছে ৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। 

বরগুনা মহাসড়ক এলাকায় এক একরেরও বেশি জমি কিনেছেন ছেলে সুনাম দেবনাথ। 
বরগুনার তালতলী উপজেলার ৪২নং মৌজার বড় নিশানবাড়ি ৪০৪ নম্বর খতিয়ানে রয়েছে ১৭.৫২ একর জমি। গাজীপুরে রয়েছে নিজস্ব জমিতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। আমতলী পৌরসভা এলাকায়ও রয়েছে তার জমি। তালতলীতে উপজাতিদের সঙ্গে প্রতারণা করে জমি হাতিয়েছেন একরের পর একর। ভারতের সল্টলেক এলাকায় রয়েছে নিজস্ব ভবন। 

কথিত আছে, ওই বাড়ি নির্মাণে বরগুনা থেকে পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে ভারতে শ্রমিক নিয়েছিলেন শম্ভু। অবৈধ সম্পদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে সংসদ-সদস্য শম্ভু বলেন, ‘আপনি চাইলে তো দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা আর প্যারিসের আইফেল টাওয়ারও আমার বলতে পারেন।

কিন্তু সেই অভিযোগ সত্য হবে কি না, সেটাই বিবেচ্য। পুরো ঢাকা শহর আমার বললেই তো আর হবে না, প্রমাণ লাগবে। যারা এসব বলছে, তাদের বলুন দুদকে অভিযোগ করতে। তারপর দুদক অনুসন্ধান করে দেখবে যে আমার এতকিছু আছে কি না। এসব পুরোটাই বানোয়াট আর মিথ্যা।’ 

দরিদ্র সংখ্যালঘু আর মন্দিরের জমি দখল করে বাগানবাড়ি : বরগুনা শহরে ঢুকে প্রধান সড়ক ধরে কিছুদূর সামনে এগোলেই হাতের বাম পাশে চোখে পড়ে দেওয়ালঘেরা সংসদ-সদস্য শম্ভুর বিশাল বাসভবন। এটিকে বাসভবন না বলে বাগানবাড়ি বললেও ভুল হবে না। 

উপজেলা পরিষদের সামনে থাকা দৃষ্টিনন্দন বিশাল পুকুরের সিংহভাগ দখল ও ভরাট করে ওই বাড়ি গড়েছেন তিনি। চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখার পাশাপাশি পুকুরের অংশে পাইলিং করে দিয়েছেন আটকে। দেওয়ালঘেরা দুটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি ছাড়াও রয়েছে গাড়ির গ্যারেজ আর নানা ধরনের গাছগাছালি। বাড়িটি করতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করেছেন শম্ভু। 

যদিও সেই খরচের উল্লেখ নেই হলফনামাসহ আয়কর রিটার্নে। বিভিন্ন সময় সংসদ-সদস্য শম্ভু বলে এসেছেন তার মায়ের পালিত পিতার দান করা সম্পত্তিতে ওই বাড়ি করেছেন তিনি। সরকার একসময় ওই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করেছিল।

কাজে না লাগায় আইনি প্রক্রিয়ায় তা অবমুক্ত করা হয়। অবমুক্ত করার পর সেখানে বাড়ি করেছেন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংসদ-সদস্যের বিশাল ওই বাড়ি সংশ্লিষ্ট মৌজার যে ৬টি দাগের জমিতে, এর কোনোটিতে নেই শম্ভু কিংবা তার মায়ের পালিত পিতার নাম। 

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বরগুনার সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে উত্তোলিত কাগজপত্রে দেখা যায়, আলোচ্য ২৪৬, ২৪৭, ২৪৯, ২৪৮, ২৩৭ ও ২৩৩ (আংশিক) দাগের জমির মালিকানায় যাদের নাম রয়েছে তারা শম্ভু কিংবা তার মায়ের পালিত বাবা অথবা এ দুপক্ষের বংশের কেউ নন।

তাছাড়া আলোচ্য ওই জমির দলিল-পর্চা এখনো সিএস রেকর্ডেই রয়ে গেছে। বিএস হয়নি। বিশাল আয়তনের ওই জমির একাংশের মালিক দাবিদার সুন্দরী কাপালী এবং নারায়ণ চন্দ্র সিংহের বর্তমান প্রজন্ম তরুণ সরকার বলেন, ‘কেবল যে আমাদের জমি দখল করা হয়েছে তাই নয়, শম্ভু বাবুর গড়া ওই বাড়ির মধ্যে একসময় মদন মোহন জিউর আখড়া বা মন্দির ছিল। 

এসএ ৮০৩ খতিয়ানে ২৪৯নং দাগে ওই মন্দিরের নামে রয়েছে ৮২ শতাংশ জমি। সেই জমিও দখল করে নিয়েছেন তিনি। আলোচ্য বাড়ির মধ্যে আমার ৫ ভাই এবং আমার নামে ১৬ শতাংশ রেকর্ডিও জমি রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বহুবার সংসদ-সদস্যের কাছে গেলেও সমস্যার সমাধান করেননি। কেবল আমার পরিবারই নয়, তার ওই বিশাল বাগানবাড়ির মধ্যে আরও অনেক সংখ্যালঘুর জমি রয়েছে। মালিক হয়েও তার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না তারা।’ 

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংসদ-সদস্য শম্ভু বলেন, ‘মন্দির আর অন্য মানুষের জমি দখল করে আমি বাড়ি বানালাম, কেউ প্রতিবাদ করল না? বাংলাদেশ কি এখনো সেই অন্ধকার যুগে আছে?

এতদিন তো আমার নামে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন-সবই হওয়ার কথা। বাড়ি তো করেছি বেশ কয়েক বছর আগে। তাহলে এখন কেন কথা উঠছে? নির্বাচন সামনে, তাই? এখানে কারও জমি আছে, প্রমাণ করতে পারলে বরগুনার সব মানুষকে ডেকে সাক্ষী রেখে বাড়ি ভেঙে জমি দিয়ে দেব। এর সবই বিরোধী পক্ষের অপপ্রচার। দলীয় মনোনয়নের আশায় এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা।’
 
শম্ভুর হাতে দল কুক্ষিগত : অনুসন্ধানে জানা যায়, এ পর্যন্ত ছয়বার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন শম্ভু। সংসদ-সদস্য হয়েছেন পাঁচবার। একবার হেরেছিলেন বরগুনার সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের কাছে।

সেটাও ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের নির্যাতিত নেতাকর্মীদের নীরব প্রতিবাদ। সেবার ‘শম্ভু ঠেকাও’ স্লোগানে নীরবে দেলোয়ারের পক্ষে কাজ করেছিলেন বরগুনা আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মী। 

একবার হারলেও পাঁচবারের সংসদ-সদস্য শম্ভু ঠিকই বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোকে রেখেছেন নিজের পকেটে। জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী প্রায় একই সুরে বলেন, ‘১৯৮৭ সালে প্রথম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন শম্ভু। এরপর থেকেই দলের হর্তাকর্তা তিনি। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীর কবির সাধারণ সম্পাদক হলে শম্ভু পদোন্নতি পান সভাপতি পদে। এরপর টানা ৩৫ বছর তার কথায় চলছে দল। যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক, পদ-পদবি পান পছন্দের ব্যক্তিরা আর কোণঠাসা হয় বিরুদ্ধ পক্ষ। প্রায় তিন যুগ চলছে এভাবেই। 

কেবল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দল রাখা নয়, নেতৃত্ব প্রশ্নে যাতে কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে আত্মীয়স্বজন আর আস্থাভাজনদের দিয়ে দল চালান এই সংসদ-সদস্য। সর্বশেষ সম্মেলনের আগে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন শম্ভুর ছেলে অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ। তরুণ লীগের সভাপতিও এই সুনাম। শম্ভুর স্ত্রী মাধবী দেবনাথ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। ভায়রা সিদ্দিকুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সুনামের স্ত্রী কাসফিয়া দেবনাথ আছেন মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে। 

সংসদ-সদস্য শম্ভুর বেয়াই নন্দ তালুকদার ছিলেন সদ্য সাবেক জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ। একই কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন নন্দর ছোট ভাই সুবল তালুকদার। শম্ভুর ভাগনি এবং বড় বোনও আছেন পৌর আওয়ামী লীগ ও জেলা মহিলা লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে। এমনকি গত বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সম্মেলনে আবারও সভাপতি হয়েছেন সংসদ-সদস্য শম্ভু। 

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগ এখন বোবা দল। জাতীয় দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালনে আটকে আছে কার্যক্রম। বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচার কিংবা এই সরকারের সাফল্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্ব। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের বয়স ৫০-৫২’র নিচে। 

অথচ এখানে যারা দলের নেতৃত্বে আছেন, তারা ৮০’র কোঠায়। এই যে বিশাল একটা ‘জেনারেশন গ্যাপ’, যে কারণে এই নেতৃত্ব তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। এ নিয়ে বহুবার বলেছি। কোনো লাভ হয় না। দলে চলছে কঠিন পরিবারতন্ত্র। নিজেদের বাইরে কাউকে বিশ্বাস করেন না দল চালানোর দায়িত্বে থাকা নেতারা।’ 

সদ্য সাবেক জেলা কমিটির যুগ্মসম্পাদক মোতালেব মৃধা বলেন, ‘সম্মেলন হয়ে গেছে, বহাল হয়েছে সাবেক হুকুম। এখন তো আর কিছু বলে লাভ নেই। তবে এটা ঠিক যে সবাই পরিবর্তন চেয়েছিল। নতুন নেতৃত্ব আর পরিবারতন্ত্রের কবল থেকে দল মুক্ত হোক, এটাই কামনা করেছিলেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভবিষ্যতে দল পুনর্গঠন প্রশ্নে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখবে কেন্দ্র, সেটাই কামনা।’ 

অভিযোগকারীদের ‘সিঙ্গেলম্যান’ উল্লেখ করে শম্ভু বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখুন, এদের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগ করেনি। বাপ-দাদার খোঁজ নিলে দেখা যাবে সবাই ছিল বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগ করতে গিয়ে জেল খেটেছি, রক্ত দিয়েছি। হুট করে কেউ এসে নেতৃত্ব চাইলেই হলো?’ 

পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুরো বরগুনায় আওয়ামী লীগ বলতে তো আমরাই। ছেলে বিয়ে করিয়েছি আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ে, মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের কাছে। এখন আত্মীয় হয়েছে বলে কি তারা রাজনীতি ছেড়ে দেবে? যোগ্যতা থাকলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা দলে পদ-পদবি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। সংসদ-সদস্য ও নেতার পরবর্তী প্রজন্ম রাজনীতি করতে পারবে না, এটা কোন বিধানে আছে? যারা এসব বলে, তাদের পরিবার কখনোই নৌকায় ভোট দেয়নি। এরা আসলে আওয়ামী লীগের বারোটা বাজাতে চায়।’ 

প্রতিটি সেক্টরেই ব্যাপক দুর্নীতি : অনিয়ম-দুর্নীতিই যেন একধরনের নিয়মে পরিণত হয়েছে শম্ভুর রাজত্বে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিওন-নৈশ প্রহরী এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যে কোনো নিয়োগে নির্দিষ্ট অঙ্কের ঘুস দিতে হয় সংসদ-সদস্য শম্ভুকে। এই অভিযোগ প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। 

সেখানে সরাসরি অভিযোগ করে বলা হয়, টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না সংসদ-সদস্য শম্ভু। টিআর, কাবিখা, কাবিটা আর ৪০ দিনের কর্মসূচির নামে কোটি কোটি টাকার ভাগবাঁটোয়ারা হয় সংসদ-সদস্য ও তার লোকজনের মধ্যে। যদিও এসব অভিযোগ সব সময়ই অস্বীকার করে এসেছেন এই সংসদ-সদস্য। 

২০২০-২১ অর্থবছরে বরগুনা সদর আসনের ৩ উপজেলায় সংসদ-সদস্যের বিশেষ বরাদ্দের আওতায় ১৮১টি প্রকল্পে ৩ কিস্তিতে ১ কোটি ১৪ হাজার ৬৬৬ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এর মধ্যে ১৮টি প্রকল্পে কিছু কাজ হলেও বাকিগুলোয় কোনো কাজ না করে টাকা উঠিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সংসদ-সদস্য শম্ভুর পছন্দের লোকজনই ছিল ওইসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে। 

মূলত টাকা ভাগাভাগি নিশ্চিত করতেই তাদের পরিকল্পিতভাবে দেওয়া হয় এসব কাজ। ওই সময় বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আহাদ সোহাগের ভাইরাল হওয়া এক অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, প্রকল্পের বরাদ্দ প্রশ্নে সংসদ-সদস্য শম্ভুকে অর্ধেক টাকা দিয়ে তারপর আনতে হয় কাজ। বাকি টাকা ভাগাভাগি হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা লোকজনের মধ্যে। যে কারণে মাঠ পর্যায়ে আর কাজ করার টাকা থাকে না। 

২০২১-২২ অর্থবছরেও ঘটে একই ঘটনা। ওই বছর টিআর, কাবিখা এবং কাবিটার আওতায় ২৮০টি প্রকল্পে বরাদ্দ আসে সংসদ-সদস্যের নামে। এর মধ্যে ২৩৩টি টিআর প্রকল্পে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৯৯৯ এবং ৪৭টি কাবিখা/কাবিটা প্রকল্পে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯২৪ টাকা বরাদ্দ পান তিনি। 

বরগুনা সদর-আমতলী ও তালতলী উপজেলায় আসা এসব উন্নয়ন প্রকল্পের একটিতেও কোনো কাজ না করে তুলে নেওয়া হয় পুরো টাকা। আমতলী সরকারি কলেজ মাঠে বালি ফেলার প্রকল্প দেখিয়ে ২ লাখ টাকা লোপাট করা হলেও ওই মাঠে এক ঝুড়ি বালিও ফেলা হয়নি বলে জানিয়েছেন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একই ঘটনা ঘটেছে চাওড়া নূরুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং আমতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। 

তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান তৌহিদুজ্জামান তনু বলেন, ‘১৪ বছর ধরে আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাছাড়া একটি ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। শম্ভু সংসদ-সদস্য থাকাবস্থায় এখানে টিআর-কাবিখাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ হয় শুনি। কিন্তু কোথায় হয়, কী হয়, তা আজ পর্যন্ত চোখে দেখিনি। ওনার ২৫ বছরের ক্ষমতার আমলে যত টাকা বরাদ্দ এসেছে, এর চারভাগের একভাগ কাজ হলেও তালতলী হতো দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপজেলা। শুনি যে কেবল টাকা বরাদ্দ আর ভাগাভাগি হয়। কাজ হতে দেখিনি কখনো।’ 

আরও জানা যায়, সংসদ-সদস্য শম্ভুর বিরুদ্ধে একবার ২৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেনসহ অন্য নেতারা। সেসময় তাকে বরগুনায় অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছিলেন তারা। সময়ের আবর্তে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে এখন দারুণ সখ্য সংসদ-সদস্য শম্ভুর। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো থেকে সরেননি অন্য নেতারা। তখনকার ওই সংবাদ সম্মেলনে শম্ভুর বিরুদ্ধে ঘুস, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ নানা অভিযোগ তোলেন স্থানীয় নেতারা।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংসদ-সদস্য শম্ভু বলেন, ‘বরাদ্দ পাওয়ার পর বিলিবণ্টন আর কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব প্রকল্পসংশ্লিষ্ট দপ্তরের। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছাড়া তো আর কোনো বিল পাশ হয় না। তিনি নিশ্চয়ই কাজ বুঝে নিয়ে তারপর বিলে স্বাক্ষর করেন। এরপরও যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, সেজন্যে আমাকে দোষারোপ করার তো সুযোগ নেই। আমি তো আর নিজ হাতে টাকা বণ্টন করি না। সরকারি অর্থ সরকারি নিয়ম মেনেই বণ্টন হয়। তাছাড়া এতদিকে তো খেয়াল রাখা সম্ভব নয়। এখানে আমাকে জড়ানোর অর্থ হচ্ছে মিথ্যার বেসাতি করে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার চেষ্টা। এখন যেহেতেু নির্বাচন আর মনোনয়নের মৌসুম, তাই আমাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে।’ 

মাদক বাণিজ্যে ছেলে সুনাম : শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ। তাদের মতে, সাগরপারের বরগুনায় মাদক চোরাচালানের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই সুনাম। 

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর বরগুনা হচ্ছে সারা দেশে মাদক চোরাচালানের অন্যতম একটি কেন্দ্র। সাগরপারের বরগুনা থেকে মাদকের বড় বড় চালান যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন সংসদ-সদস্যের ছেলে সুনাম। এখানে রাজনীতির অনেকটাও নিয়ন্ত্রিত হয় এই মাদকের মাধ্যমে। 

একবার সুনামের মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে বরগুনায় সংবাদ সম্মেলন করে জেলা ছাত্রলীগ। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জুবায়ের আদনান অনীক সেসময় সুনামের বিরুদ্ধে সরাসরি মাদক বাণিজ্যে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া শম্ভু-সুনাম এখন ‘মাবিরা’ পদ্ধতিতে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন। মাবিরা মানে ‘মাদকের বিনিময়ে রাজনীতি’। 

এখানে কিশোর-তরুণদের মাদকে আসক্ত করে তাদেরকে মাদক দিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ করান এই পিতা-পুত্র। বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যাকাণ্ড এবং কিশোর গ্যাং লিডার নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের ঘটনাও এই মাদকের কারণেই হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। 

নয়ন বন্ড ও তার কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনীকে নেপথ্যে সুনাম দেবনাথ শক্তি জোগাত বলে জানিয়েছেন বরগুনার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ-সদস্য শম্ভু বলেন, ‘সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করে দেখুক আমার ছেলে মাদক কারবারি কি না। যদি তারা প্রমাণ পায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিক। আমি তো কাউকে নিষেধ করছি না। এসবই অপপ্রচার। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এসব অপপ্রচার বাড়ে।’
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম