সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনা
ভোর হতে না হতেই ঝরল ১৪ প্রাণ
সিলেট ব্যুরো
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আলুবাহী ট্রাক ও শ্রমিক বহনকারী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছে। এতে আরও ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বুধবার ভোর ৬টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারে এ ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তি রয়েছে। ভাটিপাড়া গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে চলছে আর্তনাদ। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানায়, সিলেট মহানগর থেকে পিকআপে প্রায় ৩০ জন নারী-পুরুষ (নির্মাণ শ্রমিক) ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজারে যাচ্ছিল। দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুরে পিকআপটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আলুবাহী ট্রাকের সঙ্গে পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে ১১ জন মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর বাকিরা মারা যায়। ট্রাকের চালক পালিয়ে গেছে।
নিহতদের মধ্যে রয়েছে-সুনামগঞ্জের দিরাই ভাটিপাড়ার সিরাজ মিয়ার ছেলে মো. সৈয়ব আলী (২৭), বাদশা মিয়া (২৫), সজিব আলীর ছেলে রশিদ মিয়া (৫০), মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নুর (৬০), পাতাইয়া কাইম গ্রামের জসিম মিয়ার ছেলে একলিম মিয়া (৫০), আলীনগরের শিশু মিয়ার ছেলে হারিছ মিয়া (৫৫), গছিয়া গ্রামের বারিক উল্লাহর ছেলে সিজিল মিয়া (৫৫), মধুপুর গ্রামের সুনাই মিয়ার ছেলে সাধু মিয়া (৪০), শান্তিগঞ্জ উপজেলার বাবনগাঁওয়ের ওয়াহাব আলীর ছেলে শাহীন মিয়া (৪০), মুরাদপুরের হারুন মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া (২৬), শান্তিগঞ্জ তলের বনত গ্রামের আমান উল্লাহ তালুকদারের ছেলে আওলাদ হোসেন তালুকদার (৫০), নেত্রকোনার বারহাট্টা ইসলাম উদ্দিনের ছেলে আওলাদ হোসেন (৪০) এবং সিলেট নগরীর ৬ নং ওয়ার্ডের বাদামবাগিচার আবদুর রহিমের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪৩) ও সৌরভ (২৭)।
ওসমানীনগরের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম জানান, দ্রুত গতির দুটি যানবাহনের সংঘর্ষে পিকআপের যাত্রীরা রাস্তার দুই ধারে, ঝোপেঝাড়ে ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনার ধরন দেখে মনে হয়েছে-ট্রাকের চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। ট্রাকটি রাস্তার উলটো পাশে যাওয়ায় পিকআপের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয়দের সহযোগিতায় আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মনিরুজ্জামান জানান, দুর্ঘটনার পর মহাসড়কে হাজার হাজার গাড়ি আটকা পড়ে। লাশ ও দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন উদ্ধারের পর মহাসড়কের যানজট কমে আসে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। এদিকে, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সিলেট সফরে থাকা নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ওসমানী হাসপাতালে ছুটে যান। বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া জানান, দুর্ঘটনার পর ওসমানী হাসপাতালে হতাহতের আনা হয়। গুরুতর আহতদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ সেবা ও তাৎক্ষণিক ওয়ানস্টপ সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। এদিকে হতাহতদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। হাসপাতালের বারান্দায় কান্নারত মো. শাহীন জানান, তার ফুপাতো ভাই দুলাল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। দুলালের বড়ভাই হেলাল আহমদও তিন মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মাসখানেক আগে পরিবারের লোকজন হেলালের স্ত্রী শারমিন বেগমকে দুলাল মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর দুলালও মারা গেলেন। হাসপাতালে স্বজনহারা শের ইসলাম বলেন, আমার ভাই মারা গেছেন। এছাড়া কয়েকজন বন্ধু ও স্বজন আহত হয়েছে। নিহত মেহের মিয়ার স্ত্রী চাঁদনী বেগম আহাজারি করেন। তিনি বলেন, সকালে ডিম রান্না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু না খেয়েই বের হয়। এখন তো নিজেই চলে গেল।
দিরাইয়ের ভাটিপাড়া গ্রামে শোকের মাতম : দিরাই (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সিলেটে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকজন রয়েছে। এখন ভাটিপাড়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে ভাটিপাড়া গ্রামের খালপাড় হাটি, বাজার হাটি ও চৌধুরী হাটির বাড়িতে বাড়িতে চলছে আর্তনাদ। এ সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ স্বামী, কেউ সন্তান আবার কেউবা ভাই হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে-ভাটিপাড়া গ্রামের সৌরভ, সাধু মিয়া, তায়েফ নুর, সাগর, রশিদ মিয়া, বাদশা মিয়া ও সায়েদ নুর।
স্বজনরা জানান, এলাকায় কাজ না থাকায় নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে তারা সিলেটে যান। নির্মাণ শ্রমিক রশিদ মিয়ার স্ত্রী রাছিফা বেগম জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির (স্বামী) মৃত্যুর খবরে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। স্বামীকে হারিয়ে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েছেন।
ভাটিপাড়ার একজন জানান, গ্রামের অনেক লোক সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ছাদ ঢালাই, সড়ক ঢালাইয়ের কাজ করেন। মজুরি নগদ তাই-এ কাজে গ্রামের দরিদ্র মানুষ বেশি আগ্রহী হয়। এক সপ্তাহ আগে বেড়ানোর কথা বলে সিলেটে যায় সৌরভ মিয়া। এরপর পরিচিতদের সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে তিনি লেগে যান। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার মা আমিনা বেগম। ভাটিপাড়া গ্রামের সৈয়দপুর রহমান তালুকদার জানান, লাশগুলো গ্রামে আসার পর একসঙ্গে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হবে। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে গভীর শোক প্রকাশ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন দিরাই-শাল্লার সংসদ-সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা।
মাগরিবের নামাজের পর ভাটিপাড়া শাহি ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশগুলো দাফন করা হয়। পরিবারগুলোকে সমবেদনা জানাতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুন উপস্থিত হন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।