Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের অভিমত

ব্যাংকে সুশাসনের অভাবেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ

ঋণ আদায়ের মূল দায়িত্ব ব্যাংক নির্বাহীদের -ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ * খেলাপিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অচল করে দিতে হবে -ড. আহসান এইচ মনসুর

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংকে সুশাসনের অভাবেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ

দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। এ কারণেই ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণই পরে খেলাপি হচ্ছে।

বর্তমানে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ঋণখেলাপিদের তোষণ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ কঠোর হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকার দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

ঋণখেলাপি, ব্যাংকার-সবাই এখন সুবিধাভোগীর তালিকায়। এর নেপথ্যে থেকে প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদরা বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব।

সুশাসন না থাকায় কারও কোনো জবাবদিহি নেই। এ কারণে দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ হচ্ছে। এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না।

খেলাপি হয়ে পড়ছে। খেলাপি হওয়ার পর এসব ঋণ আর আদায় করা যাচ্ছে না। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগও হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে বেআইনিভাবে ঋণ বিতরণ করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হচ্ছে না ব্যবস্থা। ফলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেখতে হবে কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে? ঋণ আদায় হচ্ছে না কেন? সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে-ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই আইন শিথিল করে দেওয়া হচ্ছে। এতে দুর্নীতিবাজ ব্যাংকারদের আরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

তিনি আরও মনে করেন, ব্যাংককে আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরপর খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের দায়িত্ব নিতে হবে খেলাপি ঋণ আদায়ের।

কারণ, তারাই ঋণ বিতরণ করেন। তারা যদি সঠিকভাবে বিচারবিশ্লেষণ করে ন্যায়সংগতভাবে ঋণ অনুমোদন করেন, তাহলে তা খেলাপি হওয়ার সুযোগ কম।

পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণ এখন দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত ঋণ যাতে খেলাপিতে পরিণত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখন যেসব খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলো থেকে আদায় বাড়াতে হবে। ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অচল করে দিতে হবে। যখন খেলাপিরা দেখবে-ঋণ পরিশোধ না করে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই করা যাচ্ছে না, তখন বাধ্য হয়েই তারা শোধ করবে।

তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ের ভিত্তিতে রেটিং করে দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে হবে। হিসাবে যারা ফাঁকি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে হবে।

সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মন্দা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিশেষ ছাড়, তথ্য গোপন ও প্রলেপ দিয়ে খেলাপি ঋণ মাঝেমধ্যে কিছুটা কমানো হলেও তা কাজে আসছে না। নীতিমালার প্রয়োগে একটু কঠোর হলেই লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো বা কমানোর দায়িত্ব নিয়ে চলছে এক ধরনের বিতর্ক।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এতে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। ঋণ বিতরণ করেন ব্যাংকাররা, বিশেষ করে নির্বাহীরা। ঋণ যাতে খেলাপি না হয়, সেটি তাদেরই দায়িত্ব। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায় করে কমানোর দায়িত্বও তাদেরই নিতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার তাদের নীতিসহায়তা দেবে। কঠোর আইন করবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করবে। কোনো খাতে আইন প্রয়োগে শৈথিল্য থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা নেবে। বর্তমানে এগুলোর কিছুই হচ্ছে না। উলটো সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ছাড় দিচ্ছে।

সোমবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, খেলাপি ঋণ এককভাবে ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে কমানো সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। করতে হবে কঠোর আইন। বাড়াতে হবে জনবল।

বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রফউ তালুকদার এবিবি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব ব্যাংকের নির্বাহীদেরই নিতে হবে।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকার নিচে ছিল। এর আগে ২০১৯ সালে একবার খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকার ওপরে উঠলেও পরে তা কমিয়ে আনা হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে লাখ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায়। গত বছরের ডিসেম্বরে তা সামান্য কমে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে।

খেলাপি ঋণের এই হিসাবের মধ্যেও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ঋণ পরিশোধের তারিখ উত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পর খেলাপি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি খেলাপি হয় ছয় মাস পর।

এক্ষেত্রে তিন মাস ছাড় পাচ্ছে খেলাপিরা। বিশেষ ছাড়ের আওতায় খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এলটিআর মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে নবায়ন করা হয়েছে।

এসব কারণে কম দেখিয়েও খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি রয়েছে। আইএমএফ-এর হিসাবে তা ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম