শিল্প প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার বিশিষ্টজনদের মত
সাধারণ মানুষের কথার প্রতিফলন ঘটেছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুগান্তরে প্রকাশিত শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের একান্ত সাক্ষাৎকার টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে মঙ্গলবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত নানা বিস্ফোরক তথ্য। সাক্ষাৎকারের অনলাইন ভার্সনের লিংক ও ই-ভার্সনের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে। ‘মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি-লুটপাট, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, খেলাপি ঋণসহ নানা স্পর্শকাতর বিষয় অকপটে তুলে ধরেছেন।
এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, তার বক্তব্যে সাধারণ মানুষের কথার প্রতিফলন ঘটেছে। এসব বিষয় অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিষয়গুলো এড়িয়ে না গিয়ে খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে মনে করেন তারা। তাদের মতে, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ কষ্টে আছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে এবং দুর্নীতি-লুটপাট যে হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কামাল আহমেদ মজুমদার এসব তথ্য মিডিয়ায় না বলে ক্যাবিনেটে তুললে আরও ভালো হতো বলে মনে করেন তারা।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, বাজারে সাধারণ মানুষের যে কষ্ট তার বক্তেব্যে এর প্রতিফলন ঘটেছে। এর জন্য কারা দায়ী-একটা হলো ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা, আরেকটা হলো বিশ্ববাজার পরিস্থিতি। সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের অতি লোভের যে স্ফীতি ঘটেছে, তা বাজারে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। একই সঙ্গে পরিস্থিতিকে দিনদিন আরও নাজুক করে তুলছে।
এতে সাধারণ মানুষ বিপাকে আছে, কষ্টে আছে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই লোভের পেছনে কারা আছে, তা ওনার (শিল্প প্রতিমন্ত্রী) বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সে ধরনের কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশে দেখি না। কেবল বাণিজ্য নীতির দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। মূদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার হলো মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি বা ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশে এই দুই ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন না। এক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আমাদের পণ্যমূল্যের বর্তমান যে ঊর্ধ্বগতি, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকারের একজন মন্ত্রী হয়ে তিনি অকপটে সব স্বীকার করে গোমড় ফাঁস করে দিয়েছেন। এজন্য তিনি ধন্যবাদপ্রাপ্ত। সুস্পষ্টভাবে তিনি যেহেতু সিন্ডিকেটের কথা তুলে ধরেছেন, এখন সরকার তার এই তথ্য আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিলে কাজে আসবে। না হলে এগুলো কথার কথা হিসাবেই থেকে যাবে। তবে সরকারে থেকে এমন কথা সচরাচর কেউ বলেন না।
তিনি হঠাৎ করে কী উদ্দেশ্যে খোলামেলাভাবে এসব বললেন, তা স্পষ্ট হতে সময় লাগবে। প্রতিমন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মন্ত্রী-সচিবের টেবিল হয়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি সব কাজের রুলস অব বিজনেস আছে। এটা তো হতে পারে না। এরকম হয়ে থাকলে তা অবশ্যই নিয়মের ব্যত্যয়। এজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি করতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ওনার এই কথাগুলো বাস্তবতার প্রতিফলন। এগুলো মানুষের জানা। আমরাও এ ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে তুলে ধরেছি। উদ্বেগ প্রকাশ করেছি যে,
এগুলোর পরিবর্তন দরকার। মন্ত্রী নিজেই এসব তথ্য তুলে ধরায় প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা বড় ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেহেতু দল ও সরকারের অভ্যন্তর থেকে এমন কথা আসছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, এই সংকট অনেক গভীরে। এখন প্রত্যাশিত হবে, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও সরকার পরিচালনার সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন দরকার, এটা স্বীকার করে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
তিনি আরও বলেন, ওনার সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মন্ত্রণালয়ে কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারিত থাকা উচিত। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন এমন হয়েছে যে, মন্ত্রী হলেই তিনি নিয়োগ পক্রিয়ায় থাকতে চান। এই সুযোগ থেকে যখন বঞ্চিত হন, তখন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, কয়েকদিন ধরে যা কিছু হচ্ছে, আমার কাছে সেগুলো অস্বাভাবিক লাগছে। তিনি (কামাল আহমেদ মজুমদার) আমার ঘনিষ্ঠজন বা আত্মীয় নন। তার বক্তব্যও অস্বাভাবিক লাগছে। তিনি মিডিয়ায় এত কঠিন কথা বলছেন, সেগুলো কেন ক্যাবিনেটে তুলছেন না? তিনি বলছেন সব সিন্ডিকেটের দখলে, সবকিছুই খারাপ। তাহলে তিনি ওখানে আছেন কেন? এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি তো পদত্যাগ করতে পারতেন।
তিনি আরও বলেন, শিল্প প্রতিমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন, সেটা সবাই জানে। কোথাও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই, পণ্যমূল্যের পেছনে রয়েছে সিন্ডিকেট-তার এসব অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার মিল রয়েছে। তিনি যা বলেছেন, প্রায় সবই সত্য। আমরাও বিভিন্ন ফোরামে এসব নিয়ে কথা বলছি। আমাদের তো কিছু করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তার তো কিছু করার ক্ষমতা আছে। এসবের বিরুদ্ধে তার আরও শক্ত প্রতিবাদ করা উচিত। বিষয়গুলো ক্যাবিনেটে ওঠাতে পারেন। সমাধান না হলে তার প্রতিবাদে পদত্যাগ করা উচিত।
প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এফবিসিসিআই-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট মীর নাসির বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। সবাই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত না। মন্ত্রীদের সিন্ডিকেটসহ অন্যান্য বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।