একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান
উন্নয়ন টেকসই ও গতি ধরে রাখার বাজেট
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা মহামারির ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতে আরেক ধাক্কা লাগে দেশের অর্থনীতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। সেই নেতিবাচক প্রভাব এখনো চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সমাগত। তাই এবারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট তৈরি হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে। বিশেষ এ পরিস্থিতিতে কেমন হবে আগামীর সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে জনমনে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) বাস্তবায়নের অবস্থা এবং আগামী বাজেট নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে খোলামেলা কথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেছেন, আগামী বাজেট হবে উন্নয়নকে টেকসই করা এবং উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার-হামিদ-উজ-জামান
যুগান্তর : চলতি অর্থবছরের ১০ মাস চলে গেলেও আরএডিপির বাস্তবায়ন মাত্র ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ হার কম। অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই কি এমন অবস্থা?
এমএ মান্নান : এর প্রকৃত কারণ যদি আমি জানতাম তাহলে তো নিজেকে অনেক জ্ঞানী মনে হতো। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, দায়িত্ব যখন ভাগাভাগি হয় তখন সবার ওপরই সমান কাজের দায় আসে। ওই যে বলে না দশের লাঠি একের বোঝা। কিন্তু দেখা যায় সবাই সমানভাবে কাজটা করতে পারে না। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলেও এক্ষেত্রে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তারা অপেক্ষাকৃত নিচের দিকের। অর্থাৎ পিডি নিয়োগ অনেকক্ষেত্রে সঠিক হয় না।
পিডিরা জুনিয়র অফিসার হওয়ায় তারা সব সময় উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সেইসঙ্গে অর্থ বরাদ্দের পর ছাড়ের প্রক্রিয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও সেটি কাজ করছে না। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বরাদ্দে টাকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখান থেকে অধিদপ্তর, এরপর সংস্থা হয়ে প্রকল্পে চলে যায়। এই যে প্রক্রিয়াগত দেরি এবং কর্মকর্তাদের স্বাভাবগত ঢিলেমি মনোভাবও থাকে। এসব মিলে খরচ করতে দেরি হয়ে যায়।
যুগান্তর : দুই মাস পর দেখা যাবে প্রায় ৯০ শতাংশের উপরে চলে যাবে বাস্তবায়ন হার। এই শেষ দিকে এত খরচের কারণ কি?
এমএ মান্নান : অন্যান্য অর্থবছরের চেয়ে এবার আরএডিপি বাস্তবায়ন এত বেশি খারাপ বলা যায় না। কিছুটা কম হয়েছে এটা ঠিক। তবে আমরা সব সময় দেখি অর্থবছরের শেষ দিকে খরচ বেশি হয়। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। আমরা এডিপি বা আরএডিপির অগ্রগতি বিবেচনা করি টাকা খরচের মাপকাঠিতে। এখানেই যত সমস্যা। কেননা দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব কাজ হয়তো শেষ হয়েছে কিন্তু বিল বাকি আছে। সেটাকে অগ্রগতির হিসাবে ধরা যায় না। আবার দেখা যায় মাঠের কাজ হয়তো ৮০ ভাগ হয়েছে কিন্তু টাকা পরিশোধ শতভাগ শেষ। এক্ষেত্রে অগ্রগতির হিসাব ভালো দেখা যাবে। কেননা বাস্তব অগ্রগতি মাপাটা সময়সাপেক্ষ।
আইএমইডি মূল্যায়ন করলেও তো অনেকটা সময় লাগে। তবে ভয় হয় যে, দেখা যায় নতুন অর্থবছর আছে। নতুন বরাদ্দ নতুন প্রকল্প সব কিছু নিয়েই প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বাস্তব থাকেন। পুরোনোটার প্রতি যত্ন কমে যায়। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কম হওয়ার আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রকল্প পরিচালক, কর্মকর্তা এমনকি সচিব পর্যায়ে বদলি হওয়া। এতে প্রকল্পে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। দেখা যায় নতুন লোক এসে বুঝতে বুঝতেই অনেকটা সময় চলে যায়।
এটা ব্রিটিশ কালচার। বদলাতে হবে কেন। উন্নত দেশে তো পেশাভিত্তিক কর্র্মী তৈরি করা হয়। তারা নিচে জয়েন্ট করে। পরে ধাপে ধাপে উপরে ওঠে। বদলির ধারণা খুবই ক্ষতিকর। আমদের দেশে অঞ্চলভিত্তিক, জেলা ভিত্তিক এবং ক্যাডারভিত্তিক চাকরি দেওয়া হয়। যে কাউকে যে কোনো জায়গায় বদলি করা হয়।
যুগান্তর : আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হবে?
এমএ মান্নান : আগামী অর্থবছরের বাজেট ভালো হবে। কেননা আমরা যে উন্নয়নের পথে আছি, টেকঅফ পর্যায় আছি, সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে হোঁচট খেয়েছিলাম আমরা। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এটাকে ছায়াযুদ্ধ বলা যায়।
এর ফলে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও আছে। আমরা সেই অনিশ্চয়তার শিকার হচ্ছি। সবকিছু মাথায় রেখেই বাজেট তৈরি করা হচ্ছে।
যুগান্তর : বাজেট তৈরিতে বিশেষ কি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে।
এমএ মান্নান : আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য শুধু পোশাক খাত নির্ভর। এক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি অর্জন করেছি। কিন্তু সেই অর্জনেরও তো একটা সীমানা আছে। তখন আমাদের অর্থনীতির কি হবে। এজন্য রপ্তানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ করতে হবে। আমরা সেই কাজ করছি। বিশেষ করে ওষুধ, কৃষি, চামড়া ইত্যাদি শিল্পের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হবে। যাতে পণ্য বহুমুখীকরণ হয়।
যুগান্তর : জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তুষ্টির বাজেট হচ্ছে কিনা?
এমএ মান্নান : যারা ভোটার তারা তো এ দেশের জনগণ। যেমন আমার নির্বাচনি এলাকা শান্তিগঞ্জ-জগন্নাথপুরের মানুষ কি চায়। তারা চায় কৃষিতে ভর্তুকি। ডিজেল, সার, কীটনাশক ও সেচ কম দামে চায়। এছাড়া সহজে ঋণ চায়। রাস্তা, কালভার্ট, কমিউনিটি ক্লিনিকে আর একটু উন্নত সেবা-এগুলো পেলেই তারা খুশি। তাদের চাওয়া খুব বেশি নয়। এসব সরকার করছে। এগুলোর জন্য নির্বাচন প্রয়োজন হয় না। সারা বছরই সরকার যেসব কাজ করে সবই জনগণের জন্য করে।
আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক ও জনগণের সরকার। তাই যাই করা হোক না সবই জনতুষ্টি থাকবে। তবে সরকারের কিছু কাজে মানুষ সরাসরি উপকার পায়, কিছু কাজে পরোক্ষভাবে উপকার পায়। যেমন জেলা পর্যায় শিল্পকলা একাডেমি তৈরি করা হলে সাধারণ মানুষ সরাসরি কোনো প্রভাব বুঝবে না। তারা বুঝবে কৃষিতে ভর্তুকি দিলে মাস শেষে করলা, বেগুন, ধান ইত্যাদি হাতে হাতে ফল পাবে। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমি মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দেবে। দুটোরই দরকার আছে।
যুগান্তর : কৃচ্ছ সাধনের প্রভাব কেমন থাকছে বাজেটে
এমএ মান্নান : অবশ্যই এ বিষয়ে এডিপি তৈরির সময়ই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা অনেক দক্ষ। তারা বিচার বিশ্লেষণ করেই প্রকল্প নির্বাচন করেছেন। যেমন আগে আমরা মোটাদাগে পরামর্শক খাতে এবং বিদেশ প্রশিক্ষণে বরাদ্দ দিতাম।
কিন্তু এখন সত্যিই পরামর্শক লাগবে কিনা, কি ধরনের পরামর্শক, কতজন লাগবে, বিদেশ প্রশিক্ষণ কেমন হবে, কারা কারা যাবে। এসব খুঁটিনাটি বিষয় তলিয়ে দেখা হয়। ঢালাও বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
যুগান্তর : আগামী বাজেট এক কথায় কেমন বাজেট বলবেন
এমএ মান্নান : আগামী বাজেট হবে উত্তরণের বাজেট। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যাওয়া। যেসব উন্নয়ন হয়েছে সেগুলোকে টেকসই করা দরকার। অর্থাৎ চলমান স্পিড ধরে রাখার জন্য গিয়ারিংয়ের কাজ করবে বাজেট। বাজেট এক ধরনের ড্রাইভার হিসাবে কাজ করবে।