Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অভিনেতা ফারুক আর নেই

সিঙ্গাপুর থেকে লাশ দেশে আসবে আজ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অভিনেতা ফারুক আর নেই

ফাইল ছবি

‘স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্মান নেই। মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করেন, রিকশা চালান, দিনমজুরের কাজ করেন। বীরাঙ্গনা যারা, তারা তো আমারই মা, আমারই বোন, আমাদেরই কারও স্ত্রী। অথচ তাদের দেখে এখনকার প্রজন্ম উপহাস করে! নতুন প্রজন্মকে আমরা এখনো মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস বলতে পারলাম না। এখনো আমরা চেয়ার দখল নিয়েই ব্যস্ত’- একবার এক সাক্ষাৎকারে বেশ ক্ষোভ নিয়েই এসব কথা বলেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক।

অস্ত্র হাতে একাত্তরের রণাঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, অথচ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। সেই ক্ষোভ নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। সোমবার সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ অভিনেতা। (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস), সিজাব’সহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগে ভুগছিলেন ফারুক। ২০১২ সালের জুলাইয়ে এক মাস ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট সিঙ্গাপুরে যান ও সেখানকার মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে ভর্তি হন। চিকিৎসা শেষে ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। কয়েক বছর সুস্থ থাকার পর ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট ফের তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর কিছু দিন দেশে চিকিৎসা নিয়ে আবারও সিঙ্গাপুর চলে যান। সেখানে ২০২১ সালের ১৫ মার্চ তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। সেই থেকে তিনি দেশটিতে অবস্থান করছিলেন। চলছিল টানা চিকিৎসা। সেখানেই সোমবার মারা যান।

অভিনেতা ফারুকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট মানিকগঞ্জে। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার অভিষেক হয়। প্রথম সিনেমায় নায়িকা ছিলেন কবরী। এর পরে তিনি ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ নামের দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমায় তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে তার অভিনীত গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ‘সুজন সখী’ ও ‘লাঠিয়াল’ সিনেমা দুটি ব্যবসা সফল ও আলোচিত হয়। একই বছর ‘লাঠিয়াল’ সিনেমার জন্য সেরা পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত তিনটি সিনেমা ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘মাটির মায়া’ ও ‘নয়নমনি’। পরের বছর শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ অবলম্বনে নির্মিত আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমা দুটি ফারুককে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। সিনেমা দুটি নারীকেন্দ্রিক হলেও ফারুকের অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে।

পরে তার অভিনীত ‘নাগরদোলা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’, ‘ঝিনুক মালা’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘এতিম’, ‘ঘরজামাই’, ‘সখী তুমি কার’, ‘দোস্তী’, ‘সোনার তরী’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘মাসুম’, ‘হাসু আমার হাসু’, ‘মায়ের আঁচল’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘পরীস্থান’, ‘সুদ আসল’, ‘জীবন সংসার’, ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘দাদী মা’সহ আরও বেশ কিছু দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দেন তিনি। ‘মিয়া ভাই’ নামে একটি সিনেমার সাফল্যের পর চলচ্চিত্রাঙ্গনে তাকে সবাই ‘মিয়া ভাই’ নামে ডাকতে শুরু করেন। ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘আজীবন সম্মাননা’য় ভূষিত হন তিনি।

স্কুল জীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ফারুক। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময়ে তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। সিনেমা এবং রাজনীতির বাইরে ব্যবসায়ী হিসাবেও পরিচিত ছিলেন ফারুক। গাজীপুরে অবস্থিত নিজের শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘ফারুক নিটিং ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ আবেগী ছিলেন ফারুক। দেশব্যাপী অনেক মুক্তিযোদ্ধার অসহায় অবস্থা দেখে জীবদ্দশায় তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে হবে। যারা জীবন দিয়েছেন এবং যারা বেঁচে আছেন, তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা নিয়ে অনেক জায়গায় মশকরা করতেও শুনেছি। আমি নিজে অনেক জায়গায় এটাও শুনেছি, ‘আরে, আপনি মুক্তিযোদ্ধা নাকি! আপনি যুদ্ধ করেছেন!’ এটা কী ধরনের আচরণ? এসব বিষয় নিয়ে আমার ভেতর অনেক ক্ষোভ আছে। আমি ভাই স্বাধীনচেতা মানুষ, আমার ক্ষোভ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।”

ফারুকের ছেলে রওশন হোসেন শরৎ জানিয়েছেন, আজ সকাল ৭টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তার বাবার লাশ পৌঁছাবে। ফারুকের লাশের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এফডিসিতে নেওয়া হবে এবং সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারেও নেওয়া হবে। তার লাশ দাফন করা হবে গাজীপুরের কালীগঞ্জে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম