Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং

‘বুড়ো গ্যাং’ই আসল গডফাদার

দুই হাজার নামের তালিকা থাকলেও কিছুই করতে পারছে না পুলিশ

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘বুড়ো গ্যাং’ই আসল গডফাদার

অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং

‘যাত্রাবাড়ীতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে এসএসসি পরীক্ষার্থী খুন। গাজীপুরে ছাত্রীকে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা। চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং, হামলায় নিহত দুই তরুণ। বারহাট্টায় বখাটের কোপে ছাত্রী নিহত-এমন গা শিউরে ওঠা কিশোর অপরাধের একেকটি সংবাদ শিরোনাম চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনের। তবে এটাই প্রকৃত চিত্র নয়। এর আগেও কিশোর গ্যাংয়ের বলি হতে হয়েছে অনেককে।

ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, দিন দিন কিশোর অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। থামানো যাচ্ছে না। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা অপ্রতিরোধ্য। খোদ রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা রীতিমতো জিম্মি। ঘটেছে একাধিক হত্যাকাণ্ড। ভুক্তভোগীদের অনেকে জানিয়েছেন, এদের পেছনে ‘বুড়ো গ্যাং’ই আসল গডফাদার। মূলত তাদের কারণে এদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না। কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে লোক জোগান দেওয়াসহ এলাকায় দলীয় আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করা হয়। অনেক এলাকায় এসব বুড়ো গ্যাংকে বলা হয় ‘বড়ভাই’। ফলে বড়ভাইদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে কিশোর গ্যাং বন্ধ হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর অপরাধ দমনে পুলিশের উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে শুধু তালিকা করেই দায় সারছে পুলিশ। অপরাধীদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত পরিচয় জানলেও রহস্যজনক কারণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ডিএমপির মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় গুরুত্বের সঙ্গে কিশোর অপরাধ নিয়ে আলোচনা হয়। কোনো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও দু-একটি ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া রাজনৈতিক কারণেও অনেক এলাকায় কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে বেগ পেতে হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বৃহস্পতিবার দুপুরে তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাছে কিশোর গ্যাংয়ের হালনাগাদ তালিকা রয়েছে। কিন্তু কিশোরদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ১৮ বছর বয়সের নিচে কেউ অপরাধ করলে তাকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠাতে হয়। তাই কিশোর অপরাধ দমনে পুলিশি ভূমিকার চেয়ে সমাজের ভেতর থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা যেতে পারে।

পুলিশের তালিকায় দেখা যায়, ডিএমপির ৮টি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা তেজগাঁও বিভাগে। এখানকার তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং সদস্যের সংখ্যা ১০৫০ জন। বিভাগের ৮ থানা এলাকায় সক্রিয় ১৪টি গ্রুপ। এগুলো হলো-কানা জসিম গ্রুপ, মাইন উদ্দিন গ্রুপ, শাকিল গ্রুপ, মামুন গ্রুপ, লাড়া-দে, চিনে ল, কোপাইয়া দে, বাঁধন গ্রুপ, পলক গ্রুপ, গাংচিল, ঘুটা দে, চেতাইলেই ভেজাল, দ্য কিং অব গাইরালা, ভইরা দে এবং অনলি কোপাইয়া দে গ্রুপ।

সূত্র বলছে, রাজধানীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কিশোর অপরাধী তালিকাভুক্ত উত্তরায়। এলাকার কয়েকটি মদের বার ঘিরে কিশোর গ্যাং সদস্যরা রীতিমতো বেপরোয়া। এর মধ্যে জসীমউদ্দীন রোডে মার্গারিটা লাউঞ্জ নামের মদের বারে প্রায় প্রতিদিন দলবেঁধে মদ পানের পর আশপাশে তাণ্ডব চালায় বখাটেরা। এছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টরে লেকভিউ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে ঢোকা নিয়ে হট্টগোল নিত্যদিনের ঘটনা।

স্থানীয়রা বলছেন, উত্তরায় কিশোর গ্যাং লিডার হিসাবে জনৈক কবির হাসান ওরফে ভাগিনা হাসানের নাম পুলিশের তালিকাভুক্ত। এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের শেল্টারদাতা হিসাবে পুলিশের খাতায় নাম আছে জনৈক ছাত্রলীগ নেতা সাকিলুজ্জামান বিপুলের। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাদের এড়িয়ে চলে। এমনকি উত্তরা ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টরে বাহার এবং সাতিল নামের দুই বেপরোয়া কিশোর গ্যাং লিডারকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা নেই পুলিশের।

পুলিশ বলছে, মিরপুর এলাকায় পুলিশের খাতায় অন্তত ২৩টি গ্রুপের নাম আছে। এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা পাঁচশর বেশি। শুধু পল্লবীতেই আছে ৭ গ্রুপ। এর মধ্যে এক নম্বরে আছে আশিক গ্রুপের নাম। গ্যাং লিডার আসিকের সহযোগীরা হলো শামীম, রায়হান, আল-আমিন, দাদু (বর্তমানে নিষ্ক্রিয়), রাব্বি, রনি, মহিন এবং সুমন। এছাড়া আরেকটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে আমিনুল ইসলাম ওরফে আইনুল নামের জনৈক ভাসমান সন্ত্রাসী। তার গডফাদারের ভূমিকায় আছেন রাকিবুল ইসলাম ওরফে হিরা নামের জনৈক প্রভাবশালী।

সূত্র জানায়, তিতুমীর কলেজ ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা দীর্ঘদিনের। মহাখালী এলাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পরিবহণ কাউন্টারে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে একাধিক কিশোর অপরাধীর বিরুদ্ধে। তিতুমীর কলেজের জনৈক বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সানি মহাখালী এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হিসাবে পরিচিত।

রাজধানীর বনানী ৮, ৯ ও ১১ নম্বর রোডে কয়েকটি কিশোর গ্রুপ তৎপর। এর মধ্যে ২৩ এপ্রিল ১১ নম্বর রোডে একটি মদের বারে মদ পান শেষে তাণ্ডব চালায় জেরী নামের এক বখাটে। এ সময় তার কথিত বান্ধবী প্রমী বারের নিরাপত্তারক্ষীদের মারধর করে। এছাড়া মদের বারে ঢুকে হামলা চালানোর অভিযোগে রিয়াসাত আজিম ও উদয় নামের নামের দুই বখাটের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করে বার কর্তৃপক্ষ।

সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় অন্তত চারটি কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডবে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। গভীর রাতে জানালায় ঢিল ছোড়া, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, খেলার মাঠ দখলসহ নানাবিধ অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। গাংচিল নামের এক কিশোর গ্রুপের অন্তত ৪০ সদস্যের নাম আছে পুলিশের হাতে। এরা হলো-লম্বু কবির, মানিক ওরফে বোমা মানিক, ফরহাদ, মাঈন উদ্দিন, রনি, সাফায়েত, বদরুল, নুরে আলম, আক্তার, মামুন, মোহন খান, আলমগীর, হায়াত, ইউনুস, মিজান এবং জসিম। পুলিশের তালিকা অনুযায়ী গাংচিল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হলেন চন্দ্রিমা হাউজিং ও সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার, নাজিব আমজাদ এবং গ্রাম বাংলা হাউজিং এর মালিক কবির।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, গ্যাং সংস্কৃতির সঙ্গে নগরায়ণের একটা সম্পর্ক আছে। এটা মূলত আগে পাশ্চাত্য সমাজে দেখা যেত। তবে আমাদের দেশে কিশোর গ্যাং বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। এছাড়া রাজনীতিতে বড়ভাই-ছোটভাই সংস্কৃতি আছে। এগুলো আইন বা পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, অপরাধে জড়ালে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো যথেষ্ট ব্যবস্থা নয়। সমাজের ভেতর থেকে বিপথগামী কিশোরদের সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। খেলায়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের যুক্ত রাখলে অপরাধে জড়ানো থেকে তাদের বিরত রাখা যায়। প্রতিটি অভিভাবককে তার সন্তানের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, কিশোর অপরাধ নির্মূল করতে হলে পুলিশি ব্যবস্থা অনেক পরে। সবার আগে প্রয়োজন নজরদারি। এক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম