Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রাজধানীর অবৈধ ভবন উচ্ছেদ

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হুঁশ ফিরল রাজউকের

নতুন করে আর নোটিশ নয়, সরাসরি ফৌজদারি মামলা। বন্ধ করে দেওয়া হবে জরুরি পরিষেবা * প্রস্তুতি সম্পন্ন, ঈদের পর মাঠে নামছে যৌথ টিম

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হুঁশ ফিরল রাজউকের

একের এক ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনায় এবার টনক নড়েছে রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর নয় শুধু নোটিশ জারি বা উচ্ছেদ অভিযান। অবৈধ ভবন মালিকের বিরুদ্ধে সরাসরি ফৌজদারি মামলা করা হবে। একইসঙ্গে অবৈধ হিসাবে চিহ্নিত ভবনের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এজন্য ভবন পরিদর্শনের সময় ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, তিতাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আসন্ন ঈদের ছুটি শেষে এ অভিযান শুরু হবে। ইতোমধ্যে প্রস্তুতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। রাজউকের দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের সচিব ও রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা রোববার যুগান্তরকে বলেন, একের পর এক ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনায় সবাই উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর সংস্থার সমন্বয়ে ঈদের পর বৈঠক ডাকা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ এবং রাজউক যৌথ উদ্যোগ নিয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে রাজউক এবার শক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নিয়ে যৌথ অভিযান চালানো হবে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে ওই বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আগুন ঝুঁকিতে থাকা মার্কেট : রাজধানীতে একের পর এক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন প্রায় আড়াই হাজার ভবনের ভূগর্ভস্থ বেজমেন্ট পরিদর্শন করেছে রাজউক। এ সময় ৫৬৩টি ভবনের বেজমেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। কয়েকটি ভবনের বেজমেন্টে অবৈধভাবে মার্কেট, খাবার হোটেল, কাপড়ের গুদাম এমনকি বিপুল পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদের কাছে ইতোমধ্যে নোটিশ পাঠানো শুরু করছে রাজউক। তবে যাদের আগে একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাদের নতুন করে আর কোনো নোটিশ দেওয়া হবে না।

সূত্র বলছে, রাজধানীতে বেশ কয়েকটি বড় মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে নিউমার্কেট, চাঁদনীচক, ধানমন্ডি হকার্স, গাউছিয়া, রাজধানী সুপার মার্কেট, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, মৌচাক মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, পুরান ঢাকার বিক্রমপুর গার্ডেন সিটি, গুলশান শপিং সেন্টার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করার পরও এসব মার্কেটে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া এসব মার্কেটের বেশিরভাগই রাজউক অনুমোদিত নয়। ফলে সেখানে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

নকশাবহির্ভূত ভবন : রাজধানীর খিলক্ষেতে অবস্থিত রাজউক ট্রেড সেন্টারে ৫ তলা থেকে ৯ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন হিসাবে অনুমোদন নেওয়া। কিন্তু বর্তমানে সেখানে অবৈধভাবে ঢাকা রিজেন্সি নামের বাণিজ্যিক হোটেল পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ২৮ মার্চ হোটেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় রাজউক।

এতে বলা হয়, ‘২টি বেজমেন্টসহ ১৫ তলা বাণিজ্যিক ইমারতের অনুমোদন নেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে বেজমেন্টের পার্কিংস্থলে ভারী মেশিনারিজ ও শোরুম, ৭ থেকে ১৫ তলায় অফিসের অনুমোদন থাকলেও আবাসিক হোটেল এবং ভবনের ছাদে অবৈধ সুইমিংপুল ও আবাসিক হোটেল পরিচালনা করা হচ্ছে, যা ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর পরিপন্থি। এ অবস্থায় ভবনের অবৈধ ব্যবহার ও কাঠামো স্ব-উদ্যোগে অপসারণ না করা হলে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী অবৈধ কাঠামো রাজউক কর্তৃক অপসারণ করা হবে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হোটেলের বিশাল ছাদের আয়তন ২২ হাজার বর্গফুটেরও বেশি। এর একদিকে মদের বার অন্যদিকে সুইমিংপুল করা হয়েছে। প্রতি রাতেই সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি চলে। এতে বিপুলসংখ্যক লোকজনের সমাগম ঘটে। একমাত্র লিফট ব্যবহার করে সেখানে যেতে হয়। কিন্তু আগুন লাগলে কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনার সময় সেখান থেকে জরুরি বহিঃনির্গমনের রাস্তা নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে অবৈধভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পাইপ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সিঁড়ি। ফলে আগুন লাগলে বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় লিফট বন্ধ হয়ে গেলে দ্রুততম সময়ে ভবন থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হয় এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে।

রাজউক বলছে, রাজধানীর নয়াপল্টনের ৭১-৭২ নম্বর হোল্ডিংয়ে অবস্থিত অরচার্ড প্লাজা নামের ১৩ তলা ভবনটিও অবৈধ। এটি নির্মাণে রাজউক অনুমোদিত নকশার ছিটেফোঁটাও মানা হয়নি। বেজমেন্ট ছাড়াই বিশাল ভবন নির্মিত হয়েছে। পরে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয় ইচ্ছেমতো।

সূত্র জানায়, ভবনটি একাধিকবার ভাঙার উদ্যোগ নেয় রাজউক। কিন্তু প্রভাবশালীদের তদবিরে তা সম্ভব হয়নি। ভবন অপসারণে মালিকপক্ষকে কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু এতে লাভ হয়নি। ২০০৭ সালে একবার ভবনে বুলডোজার লাগানো হয়। কিন্তু তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টার তদবিরে সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন রাজউক কর্মকর্তারা। সম্প্রতি চিঠি চালাচালির মধ্যে রাজউক থেকে অরচার্ড প্লাজার ফাইল গায়েব করে ফেলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, উত্তরা সোনারগাঁও জনপথ রোডের জমজম টাওয়ার নির্মাণে নকশা জালিয়াতি করা হয়। এর নেপথ্যে আছেন রাজউকের এক সময়ে প্রভাবশালী ঠিকাদার মনির ওরফে গোল্ডেন মনির ও স্বর্ণ চোরাকারবারি পরিচিতি সাবেক একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এছাড়া রাজধানীর মালিবাগে ফরচুন টাওয়ার শপিং সেন্টার নির্মাণের পর রাতারাতি ফাইল গায়েব করে ফেলা হয়। নামে-বেনামে ফরচুনের মালিকানায় আছেন এক সময় রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ড টেরর হিসাবে পরিচিত মোতাহার-আকরাম-আবুল-জিন্নাহ গ্রুপ। এছাড়াও গুলশানের জব্বার টাওয়ার, কাকরাইলের হোটেল রাজমনি ঈশাখাঁ, পল্টনের চায়না টাউন মার্কেট এবং বনানীর আহম্মেদ টাওয়ারসহ অবৈধ ভবনের সংখ্যা কয়েক হাজার।

সূত্র বলছে, রাজউকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভবন নির্মাণ দূরের কথা একটি ইট গাঁথাও সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি এলাকায় রাজউকের একাধিক ইমারত নির্মাণ পরিদর্শক রয়েছেন। যাদের প্রধান কাজ নকশা অনুমোদন দেওয়ার পর নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কিনা তা পরিদর্শন করা। এছাড়া ইমারত নির্মাণ পরিদর্শকের উপরে রয়েছেন প্রধান ইমারত নির্মাণ পরিদর্শক, সহকারী অথরাইজড অফিসার, অথরাইজড অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট জোনের পরিচালক। কিন্তু সবার চোখের সামনে অনেকে নকশাবহির্ভূতভাবে অবৈধ ভবন নির্মাণ করছেন। কিন্তু বাস্তবে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে কিভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তর ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ এখন ওপেন সিক্রেট।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম