বৈষম্য বাড়ার প্রভাব
স্বল্প-মধ্যম আয়ের মানুষ প্রবৃদ্ধির সুফলবঞ্চিত
উন্নয়ন হলে বৈষম্য বাড়বেই এটি ভ্রান্ত ধারণা -ড. মোস্তফা কে. মুজেরী * সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যাপক সংস্কার দরকার -ড. জাহিদ হোসেন
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেওড়াপাড়ায় শামিম সরণি মোড়ে রিকশা নিয়ে বসে ছিলেন চালক মো. সুজন মিয়া। জানতে চাইলাম ইনকাম কেমন হচ্ছে? প্রথমে প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে উঠলেন।
পরে বললেন, ভাই কী আর কমু, যা আয় করি তার চেয়ে খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। আগে আয় কম হলেও কিছু টাকা জমাতে পারতাম। এখন আয় বেশি হয়। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, এতে আর কুলানো যায় না। বৈষম্য কাকে বলে, সেটি না বুঝলেও তিনি নিজের অবস্থার বর্ণনা দিলেন এভাবেই। একই মন্তব্য কুড়িগ্রামের কৃষক (গৃহস্ত) মো. নিজাম উদ্দিনের।
তিনি বলেন, আগে ধানচাষে যে খরচ হতো, এতে ৫০০ টাকা মন বিক্রি করেও পোষাত। এখন এক হাজার থেকে ১২শ টাকা মন বিক্রি করেও লাভ আসে না। একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের মধ্যে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নের একটি পর্যায়ে বৈষম্য বাড়াটাই স্বাভাবিক-এ মত পুরোনো এবং এটা ভ্রান্ত ধারণা। কেননা আয়বৈষম্য আমাদের নিয়তি নয়, এটা সমাধান সম্ভব। এজন্য সরকারিভাবে আলাদা নীতিমালা নেওয়াটা জরুরি। তা না হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুফলবঞ্চিত হবেন সাধারণ মানুষ। বৃহস্পতিবার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন মন্তব্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, বুধবার খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দেশে দারিদ্র্য হারে উন্নতি হলেও বেড়েছে বৈষম্য। অর্থাৎ কারও আয় অনেক কম, আবার কারও আয় অনেক বেশি।
আয়বৈষম্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, গিনি সহগের মান (বিশ্বব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি) শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২। ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোগবৈষম্যও। ২০২২ সালের হিসাবে ভোগব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪। তবে ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২১।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ডা. তানজিবা রহমান বলেন, আয়বৈষম্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিকার এদেশের নারীরা। পুরুষের চেয়ে তাদের আয় অনেক কম। এক্ষেত্রে শুধু যে সরকারি নীতি বা সামাজিক অবস্থাই দায়ী, তা নয়। আমাদের দেশের নারীদের মানসিকতাও দায়ী।
কেননা তারা ভাবে লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত স্বামী খুঁজে নেওয়াটাই তাদের কাজ। এরকম চিন্তা থেকে চ্যালেঞ্জিং পেশায় তারা যেতে চান না। ফলে তারা বৈষম্যের শিকার হন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ১৯৬০-৭০ দশকে একটি ধারণা ছিল অর্থনীতিতে কিছু বৈষম্য থাকা ভালো। আয় যাদের বেশি হবে তারা বশি সঞ্চয় করবেন। বেশি সঞ্চয় হলে বেশি বিনিয়োগ করতে পারবেন। আবার বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং মানুষের আয়ও বাড়বে।
এছাড়া দেশ উন্নত হলে বৈষম্য বাড়বেই। পরে আবার কমে আসবে। এক্ষেত্রে চিন্তার কোনো কারণ নেই। এ দুই থিয়োরিই ভ্রান্ত। এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই। বাস্তবতা হলো-বৈষম্য কম থাকলেই বরং প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। সবার মধ্যে প্রবৃদ্ধির সুফল সমানভাবে বণ্টিত হয়ে টেকসই উন্নয়ন হয়।
বৈষম্য প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকারক। বৈষম্য ক্রমাগত যে বাড়ছে, তা স্পষ্ট হয়েছে ২০২২ সালের বিবিএস-এর প্রতিবেদনে। শহরে এটি আরও বেশি হয়েছে। আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য আছে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগ দিয়ে বৈষম্য কমবে না। বৈষম্য ও দারিদ্র্য দুটি ভিন্নধারার সমস্যা। এজন্য বৈষম্যবিরোধী নীতি দরকার। বৈষম্য কমানোই এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিবিএস-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরে বৈষম্য বেড়েছে। কিন্তু গ্রামে কমেছে। বৈষম্য বাড়াটা কোনো নিয়তি নয়। তাই যদি হতো তাহলে গ্রাম ও শহর সব জায়গায়ই বৈষম্য সমান হতো। সেটি হয়নি। শহরে অতিমাত্রায় বৈষম্য বৃদ্ধির প্রভাবে জাতীয় পর্যায়ে আয়বৈষম্য বেড়েছে।
বিবিএস-এর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে শ্রমিকের আয় কমেছে। শহরগুলোয় বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা অবস্থিত। শহরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বেশি। এর সুফল শ্রমিক পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে লাভবান হচ্ছেন বড় শিল্প মালিক, বাড়ির মালিক (যারা ভাড়া দেন) এবং ব্যাংকসহ যারা শিল্পে ঋণ দেন তারা বেশি সুদ পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো সম্পদ থেকে আয় বেড়েছে।
কিন্তু শ্রম থেকে আয় কমেছে। তবে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে যে আয় বাড়ানো হয়েছে সেটিও নয়। কেননা এখানে ঋণখেলাপিও আছে। আবার উৎপাদনশীলতা থেকে যে আয় বেড়েছে, সেটিও বলা যায় না। তবে আয়বৈষম্য কমাতে হলে সরকারকে চিন্তা করতে হবে কোন ধরনের শিল্প সুরক্ষা দিতে হবে।
এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাজরে বিক্রয়যোগ্য শ্রমঘন শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হবে। তাহলে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। এজন্য শিল্পনীতির সংস্কার দরকার। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। শুধু গ্রামে বাস্তবায়ন না করে শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করতে হবে এসব কর্মসূচি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, দেশ উন্নতি করলে একটা সময় বৈষম্য হবেই। এ যেন নিয়তি। এ কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। এসব কথা যারা বলেন, তারা আধুনিক অর্থনীতি সম্পর্কে অবহিত নন। যেসব কারণে বৈষম্য বাড়ে, সেসব কারণ পৃথিবীতে যথেষ্ট পরিমাণে চিহ্নিত হয়েছে এবং সমাধানের প্রচেষ্টাও হয়েছে।
তবে বাংলাদেশে বৈষম্য কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপক বাড়ানো দরকার। আমাদের সরকারের যদি যথেষ্ট আয় থাকত, অর্থাৎ যথেষ্ট রাজস্ব আদায় করতে পারত, তাহলে সামাজিক নিরাপত্তার মতো কর্মসূচিতে বিনিয়োগ বাড়ানো যেত। তবে যারা বলে উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্য হবেই, তারা নীতিমালা তৈরি ও প্রয়োগের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই এসব কথা বলেন।