জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর শোক
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন আজ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর লাশ আজ সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নেওয়া হবে।
সেখানে দুপুর ১টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম জানাজা হবে। আর আগামীকাল সকাল ১০টায় লাশ নেওয়া হবে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ জুমা দ্বিতীয় জানাজা হবে।
এদিকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা।
বুধবার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আলতাফুন্নেসা বলেন, ‘তাকে (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) সমাহিত করা হবে, নাকি দেহ দান করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। পরিবারের সদস্যরা বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছোট বোন আলেয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত জানি পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য মরদেহ দান করার পক্ষে। তিনি কয়েকবার বলেছেন দেহ দান করতে। আমরা তার কথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’ আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু বলেন, ‘কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানানোর পর মৃত্যুদেহ দান বা দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাৎ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. নাজিমুদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু প্রমুখ।
মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মারা যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কয়েকদিন সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তার লাশ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহলের শোক : বুধবার শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক বিবৃতিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। আর নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শোকবার্তায় বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান অতুলনীয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি তার আত্মার প্রতি সম্মান জানাচ্ছি।’
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ, ওষুধশিল্প ও জনস্বাস্থ্য খাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ তিনি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে বিএনপি। শোকবার্তায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর সেনানী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আজীবন দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী। আওয়ামী সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ এবং ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার ছিলেন তিনি।
এছাড়া ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. নূরল আলম, এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুসহ বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সংস্থার নেতারা শোক জানিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে শোক জানিয়েছেন।
একাত্তরে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়নে বড় ভূমিকা রাখেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে দরিদ্রদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তিনি গরিবের ডাক্তার খ্যাতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রাখেন। খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কোনো দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতিসচেতন এই ব্যক্তি বলতেন, ‘আমি মানুষের রাজনীতি করি।’
শেষ বিদায় জানাতে অধীর আগ্রহে রাউজানের মানুষ : রাউজান (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শেষ বিদায় তার জন্মভিটায় হোক এমনটা দাবি তার গ্রামের মানুষের। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কোয়েপাড়ায়। ছোটবেলায় কোয়েপাড়া বোর্ড প্রাথমিকে শিক্ষাজীবন শুরু করলেও বাবার চাকরির সুবাদে গ্রামের স্কুল ছেড়ে অন্যত্র লেখাপড়া করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে গ্রামের সঙ্গে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। মানুষদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। যেকোনো দুর্যোগে অথবা এলাকার অসহায়দের সাহায্য বিতরণের সময় তিনি সাবধান করতেন যেন কোনো অবস্থাতে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ বিবেচনায় না আসে। সবাইকে এক কাতারে রেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি।
মৃত্যুর খবর শুনে বুধবার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গ্রামের বাড়িতে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা ভিড় জমান। কোয়েপাড়া বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারী মনিকা নন্দী বলেন, ‘মাথার ওপর থেকে ছাদটা চলে গেছে।
তিনি আমাদের খোঁজখবর নিতেন সাহায্য পাঠাতেন।’ প্রতিবেশী তাসনুভা আরফিন বলেন, ‘মাস ছয়েক আগে উনার বোনের স্বামীর মৃত্যু হলে বাড়িতে আসেন। সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটাকে শেষবারের মতো যেন বাপ-দাদার ভিটে থেকে বিদায় দেওয়া হয়।’ সাবেক শিক্ষিকা আকতার জামান বলেন, ‘এলাকার মানুষের জন্য অসম্ভব দরদি ছিলেন তিনি।’
ছোটবেলার বন্ধু সাবেক অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘অতি জনদরদি, নিরহংকার ও সৎ ব্যক্তিত্ব ছিলেন জাফরুল্লাহ। দেশের মানুষের জন্য তার অবদান অবিস্মরণীয়।’ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল্লাহ্ চৌধুরীর বরাত দিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ভূপেশ বড়ুয়া বলেন, ‘তার (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) লাশ শুক্রবার গ্রামের বাড়িতে আনার কথা রয়েছে।’