Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

৫ বছরে লক্ষাধিক অগ্নিকাণ্ড

শুধু তদন্ত হয় বাস্তবায়ন হয় না গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুধু তদন্ত হয় বাস্তবায়ন হয় না গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ

দেশে অগ্নিকাণ্ডে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি, ঝরছে প্রাণ। বড় কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটলেই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত হয়, দেওয়া হয় নানান সুপারিশও।

থামে না অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা, মানুষ হতাহত হয়, সম্পদের ক্ষতি হয় বিপুল, রাতে যিনি কোটিপতি, তিনি সকালে হয়ে যান পথের ভিখারি। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না কোনো সুপারিশ। যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলছেন, যতদিন তদন্ত কমিটির সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে না ততদিন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ১০ হাজার ৪৯২টি। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এসব অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে ৭৭২ জন। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা না গেলেও ক্ষতিগ্রস্তদের ধারণা হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের বড় ঘটনাগুলোতে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনেই বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সুপারিশমালা খুব কমই বাস্তবায়ন হয়। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গেলে সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদের আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ কারণে তারা তা বাস্তবায়ন করেন না। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কঠোর হওয়ার সুযোগও কম। কঠোর হওয়ার মতো তেমন কোনো আইনও তাদের হাতে নেই। যে কারণে সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই দেখি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত হয়, প্রতিবেদন জমা হয়। কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।’ তিনি মনে করেন, সব অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এছাড়া যাদের গাফিলতির কারণে এমন অগ্নিকাণ্ড ঘটছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না।

ফায়ার সার্ভিস মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক দোলন যুগান্তরকে বলেন, শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ৮-১০টি আগুনের ঘটনা ঘটে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে গণমাধ্যম জানতে পারে। তাছাড়া বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ৯ জুলাই রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজে অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানে একটি ১২ তলা আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দুজন নিহত হন। এ ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশও আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। নকশা অনুমোদন এবং নির্মাণ কাজের ত্রুটির জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা-কর্মচারী, সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রতিষ্ঠানের অনেককে দায়ী করে ২০১৯ সালের ২২ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ভবনটির ১৮ তলার ওপরের অংশ অবৈধ উল্লেখ করে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেমসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। অন্য কমিটিগুলো প্রায় একইরকম প্রতিবেদন দেয়।

এর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এ অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এসব কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়া এবং অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু চার বছরেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে ২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে-পরিকল্পিতভাবে কেমিক্যাল শিল্প জোন গড়ে তোলা। এরপর সেখানে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া। এর পাশাপাশি দাহ্য কেমিক্যাল আনা-নেওয়া বন্ধ করাসহ নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। কিন্তু এত বছরেও প্রধানমন্ত্রীর সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।

২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যার পর মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ নামের ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি। ঘটনায় পরদিন ২৮ জুন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে রাজধানীর রমনা থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। মামলাটির তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদন ২০২১ সালেই হাতে পায় মামলার তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি। কিন্তু বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত শেষ হলেও সিটিটিসিকে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছিল না। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ড. আব্দুল হান্নান যুগান্তরকে বলেন, গত মাসে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, জমাটবাঁধা গ্যাস থেকেই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এমনটিই তারা উল্লেখ করেছেন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন তল্লা এলাকার সবুজবাগে বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, সিটি করপোরেশন। সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে অনিয়ম ও গাফিলতির নানা তথ্য। তিতাসের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালে স্থাপন করা একটি লাইনের বদলে ১৯৯৮ সালে নতুন লাইনের সংযোগ পান কয়েকজন গ্রাহক। গ্রাহকের বাড়ির সামনে থেকে পুরোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও তখন সড়কের মূল লাইন থেকে তা বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। পরে পরিত্যক্ত ওই লাইনের ওপর নির্মাণ করা হয় মসজিদ। মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখা গ্যাস রাইজার এবং মসজিদ নির্মাণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত পুরোনো বিতরণ লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। সেই গ্যাস মসজিদের বেইজমেন্ট ভেদ করে ভেতরে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জমা হয়। ওই ঘটনায় আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে অন্তত ২০ কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৭টি কারণে বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর বিস্ফোরণে ঘটা অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগে বিস্ফোরণ, গ্যাসের চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, শিল্প কারখানার বয়লার বিস্ফোরণ, যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বিভিন্ন রাসায়নিকের বিস্ফোরণ ও নিম্নমানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির বিস্ফোরণ উল্লেখযোগ্য।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম