বঙ্গবাজারে বারবার ‘রহস্যঘেরা’ আগুন
চতুর্মুখী স্বার্থে সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীরা
পোড়া মার্কেটের জায়গা বরাদ্দ পেতে আগে থেকেই তৎপর দুটি সংস্থা * ডিএসসিসি নির্মাণ করতে চায় বহুতল ভবন, এজন্য মাটির গুণগত মানও পরীক্ষা করা হয় * অবৈধ বাণিজ্য কবজায় রাখতে পাকা ভবন তৈরিতে বাধা ব্যবসায়ী নেতারা
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ব্যস্ততম বঙ্গবাজারে দৃষ্টি পড়েছে একাধিক গোষ্ঠীর। ওই জমিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বহুতল মার্কেট তৈরি করতে চায়।
নিজস্ব সংস্থার নামে পুরো জায়গা বরাদ্দ পেতে অনেকদিন ধরেই তৎপর দুটি সংস্থা। আর ব্যবসায়ী নেতারা চান নিজেদের কবজায় যেমন আছে, তেমনই থাকবে বঙ্গবাজার।
চতুর্মুখী এই স্বার্থের দ্বন্দ্বে বলি হচ্ছেন এখানকার হাজারো ব্যবসায়ী। এবার নিয়ে এখানে তিন দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। প্রতিবারই ধ্বংস হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
মার্কেটের আগুন নিয়ে প্রতিবারই ওঠে নানা প্রশ্ন। কিন্তু রহস্য উন্মোচিত হয় না। মঙ্গলবার তৃতীয় দফায় লাগা আগুন সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে যায় বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্সের ৫ হাজার দোকান। পুড়েছে আশপাশের মার্কেটের কয়েক শ দোকানও। টানা ১০ ঘণ্টা দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের ঘটনাকে এবারও ‘রহস্যঘেরা’ বলছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে আছে পরিকল্পিত ‘নীলনকশা।’ কারও মন্তব্য-‘ষড়যন্ত্রের আগুনে তাদের সর্বস্বান্ত করা হলো।’ এসব দাবি ও মন্তব্য করতে গিয়ে কিছু ক্লু তুলে ধরেছেন তারা। বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও বহুতল ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কারা লাভবান হবেন, তা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া এ জায়গা বরাদ্দ পেতে কোন কোন সংস্থা অনেক আগে থেকেই দৌড়ঝাঁপ করছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আবার হাজার হাজার ব্যবসায়ীকে ঝুঁকির মুখে রেখে কারা দীর্ঘদিন ধরে বহুতল ভবন নির্মাণে বাধা হয়ে ফায়দা লুটছে, নজরদারিতে আনতে হবে তাদের গতিবিধিও। তাহলেই আলোচিত এই মার্কেটে দফায় দফায় অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হতে পারে। যুগান্তরের অনুসন্ধান ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবাজার এলাকায় আছে অন্তত ১০টি মার্কেট। এর মধ্যে বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্সের আওতায় চারটি। এগুলো পরিচালনার জন্য আলাদা সমিতি আছে। কাঠ ও টিনের তৈরি তিনতলা মার্কেটটি এবারের আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, এই মার্কেটে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে।
তখন মার্কেট ছিল দোতলা। আগুনে পোড়া ওই মার্কেটের দোকান মালিকদের পুনর্বাসনের জন্য গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল বঙ্গবাজার মার্কেট পুনর্নির্মাণের পর সেখানে তারা আর দোকান পাবেন না। কিন্তু মার্কেট নির্মাণের পর সমিতির নেতাদের যোগসাজশে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা তাদের পুরোনো দোকানে বহাল থাকেন। এতে কিছু কিছু দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী নেতা ব্যাপক লাভবান হন। এখানেই শেষ নয়, দোতলা পোড়া মার্কেটের জায়গায় তখন নির্মাণ করা হয় তিনতলা। সেখানে নতুন দোকান বরাদ্দ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সমিতির নেতারা। তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই স্লোগান চালু হয়েছিল-‘এক কাগজে তিন দোকান। শাজাহান ভাইয়ের অবদান।’ জনৈক শাজাহান ওই সময় বঙ্গবাজার মার্কেটে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। ২০১৮ সালে বঙ্গবাজারে দ্বিতীয় দফায় আগুন লাগে। তবে সেবার ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। দ্বিতীয় দফা অগ্নিকাণ্ডের পর ২০১৯ সালে ফায়ার সার্ভিস মার্কেটটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। মার্কেটটি ভেঙে ফেলার সুপারিশও করা হয়।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিস মার্কেটটি ভাঙার সুপারিশ করার পরই একটি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। চক্রের সদস্যরা ডিএসসিসির তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারের সঙ্গে বসে বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করে। তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘ম্যানেজও’ করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গার মাটির গুণগত মান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মার্কেটটি উচ্ছেদে নোটিশ জারি হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ী নেতারা হাইকোর্টের মাধ্যমে উচ্ছেদ আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে ঝঁকিপূর্ণ এই মার্কেট পরিচালনা করতে থাকেন। এর পেছনে আছেন প্রভাবশালী এক সংসদ-সদস্য। হাইকোর্টের আদেশের কারণে তখন মার্কেট উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়েছে ডিএসসিসি। ২০২০ সালে করপোরেশনে ক্ষমতারও পালাবদল হয়। বর্তমান মেয়র বহুতল মার্কেট নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অগ্নিকাণ্ডের পর মঙ্গলবার মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘২০১৯ সালেই এই মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপরও এখানে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত অনাকাক্সিক্ষত। আমরা ১০ বার নোটিশ দিয়েছি। এছাড়া আমরা বঙ্গবাজার মার্কেটে বহুতল ভবন নির্মাণের কার্যক্রম নিয়েছি। সেখানে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে।’
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, একাধিক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। হাইকোর্টের আদেশের কারণে তারা মার্কেট উচ্ছেদ করতে পারছেন না বলে ষড়যন্ত্র করেছে। মহানগর কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী আশরাফ উদ্দিন মানিক বলেন, ‘আগুন ধরার পর ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এলেও কিছুক্ষণ পরই তারা বলে পানি নেই। মার্কেট যখন পুড়ে ছাই, তখন তাদের পানির স্পিড বেড়ে যায়। আর যেভাবে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তা স্বাভাবিক নয়। এটা পুরো সাজানো নাটক।’
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বঙ্গবাজার ও পাশের মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের জায়গার ওপর দুটি সরকারি সংস্থার নজরও অনেক দিনের। তারা এই জমিতে নিজস্ব অফিসের জন্য বরাদ্দ পেতে অনেক আগে থেকেই মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু একটি সংস্থাকে দিলে আরেক সংস্থা নাখোশ হতে পারে বলে কাউকেই বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।
মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের মার্কেটের জায়গা কাউকে বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া জায়গায় আমরা মার্কেট করেছি। এজন্য নিয়ম অনুযায়ী রেলওয়েকে টাকাও পরিশোধ করা হচ্ছে।’
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। নিজ কার্যালয়ে বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত চলা বৈঠকে যোগ দেন সংসদ-সদস্য রাশেদ খান মেনন, আফজাল হোসেন, মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, বঙ্গবাজার মার্কেটের সভাপতি হুমায়ন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম ও গুলিস্তান মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা। বৈঠক শেষে পোড়া মার্কেটের নিরাপত্তায় ১ প্লাটুন আনসার ও সার্বক্ষণিক পুলিশ সদস্য মোতায়েনের নির্দেশ দেন মেয়র। দ্রুত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে দোকান বসিয়ে ঈদের আগে ব্যবসা করার সুযোগ চান ব্যবসায়ী নেতারা। এ ব্যাপারে মেয়র তাদের আশ্বস্ত করেন।
গুলিস্তানের পুরোনো একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, ঢাকায় বিরোধপূর্ণ মার্কেট খালি করার প্রধান হাতিয়ার এখন পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড। পোড়া মার্কেটে পরবর্তী স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনাতেই সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবাজার মার্কেটের পরবর্তী নির্মাণকাজেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক ব্যবসায়ী জানান, বিএনপি সরকার আমলে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার। এরপর সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল পাকা দালান। ওই আগুনের ঘটনায় তখনকার ‘বিতর্কিত’ কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের দিকে সন্দেহের আঙুল তুলেছিল সবাই। বঙ্গবাজারের এই আগুনের পেছনেও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছেন ব্যবসায়ীরা। আর এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে পুরান ঢাকার বর্তমান একজন কাউন্সিলরের যোগসাজশ থাকতে পারে বলে অনেকেই সন্দেহ করছেন। সব পরিকল্পনা সাজিয়ে তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন কি না, তাও খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।
বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক বিএম হাবীব বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ-এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। স্বার্থান্বেষী মহল দীর্ঘদিন ধরে এই মার্কেটের জায়গা দখলের চেষ্টা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদে আগুন লাগানো হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত কি না, তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদ নেতারা। পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব নূরুল হক নূর বলেন, এ ঘটনার পেছনে বিশেষ মহলের স্বার্থ জড়িত কি না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।