জন্ডিস ও জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে প্রতারণা
৬ হাজার নারীর দেহে নকল ভ্যাকসিন
৩ বছর ধরে মাইকিং করে প্রচারণা চালিয়ে চক্র হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডিবির হাতে গ্রেফতার পাঁচ টিকা প্রতারক -সংগৃহীত
জরায়ু ক্যানসারের পরিচিতি, এর ভয়াবহতা, লক্ষণ, প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং টিকা নেওয়ার সময়সূচি উল্লেখ করে তৈরি করা হয় লিফলেট। রাজধানীর দক্ষিণখানের সেলিনা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের নামে তৈরি করা এই লিফলেট বিতরণ করা হয় পাড়া-মহল্লাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। লিফলেটে প্রতিডোজ ভ্যাকসিনের মূল্য ধরা হয় দুই হাজার ৫০০ টাকা।
একই প্রতিষ্ঠানের নামে তৈরি করা অপর লিফলেটে হেপাটাইটিজ-বি (জন্ডিস)-এর পরিচিতি, জন্ডিজের কারণ, এ সংক্রান্ত ভ্যাকসিনের চার্জ ইত্যাদি উল্লেখ করে তৈরি করা হয় আলাদা লিফলেট। রীতিমতো মাইকিং করে বিতরণ করা হচ্ছিল এসব লিফলেট।
এ বিষয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে সেলিনা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মুর্শিদা আক্তার পপি জানান, তারা এ সংক্রান্ত কোনো ভ্যাকসিন দিচ্ছেন না। তাদের নাম ব্যবহার করে চলছে প্রতারণা। টিকার নামে মানুষের শরীরে দেওয়া হচ্ছে পানি। কখনো কখনো দেওয়া হচ্ছে নকল টিকা। ইতোমধ্যে প্রতারক চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু সেলিনা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের নামেই নয়। এ রকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের নামে চলছিল প্রতারণা। গত তিন বছরে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার নারীকে জরায়ু ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কেবল গাজীপুর অঞ্চলেই চার হাজার নারীর শরীরে টিকার বদলে দেওয়া হয়েছে শুধুই পানি। এছাড়া জন্ডিসের টিকার সঙ্গে পানি মিশিয়ে আরও দুই হাজার নারীকে দেওয়া হয়েছে নকল টিকা। এভাবে ছয় হাজার নারীর শরীরে নকল ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতারক চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা।
এছাড়া জন্ডিসের টিকার নামে বহু মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরের ইএসএসডি পাইলট স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়েছে জন্ডিসের ভুয়া টিকা। ১২ বছরের নিচে শিশুদের জন্য টিকার প্রতিডোজে ৩০০ টাকা এবং ১২ বছরের ওপরে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা করে। লিফলেটে বলা হয়, চারটি ডোজ নিলে সারা জীবন হেফাটাইটিজ-বি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
ব্যানার, পোস্টার আর মাইকিং করে এমন প্রতারণার পর প্রশ্ন উঠেছে-কয়েক বছর ধরে দেওয়া এই নকল ভ্যাকসিনের দায় কার? এ বিষেয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানান, জরায়ুর মুখের ক্যানসারের জন্য আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে এসপিবি ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করবে সরকার। এর আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতারক চক্রের সদস্যরা। বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো ধরনের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম স্কুল-কলেজে না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, সারভারিক্স ভ্যাকসিন (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাকসিন) নকল পাওয়া গেছে। আনরেজিস্টার্ড (আমদানি নিষিদ্ধ) হেপাটাইটিস-বি টিকা ভায়াল থেকে খালি ভায়ালে আংশিক ভরে সারভারিক্স ভ্যাকসিনের নকল লেবেল লাগিয়ে একটি নকলবাজ চক্র সরবরাহ করেছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ভুয়া বা নকল টিকা কার্যক্রম স্থানীয় প্রশাসন বা সরকার কারও চোখেই পড়ল না। ভ্যাকসিন যারা নিয়েছেন তারাও বুঝতে পারলেন না। প্রতারকরা এত অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে যে, বুঝতে বুঝতেই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।
তিনি বলেন, প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, তারা কোথা থেকে টিকা দিচ্ছে? যে প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান কিনা?
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একজন ভুক্তভোগী নারী বলেন, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি আবাসিক এলাকা, শেখেরটেক, আদাবর ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, সাতমসজিদ হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা মডেল টাউন এবং বাঁশবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত জরায়ু ক্যানসার এবং জন্ডিসের টিকাসংক্রান্ত বিষয়ে নিয়মিত মাইকিং করা হতো। বিতরণ করা হতো লিফলেট। ওই লিফলেট দেখে এবং মাইকিং শুনে আমি টিকা দিতে উদ্বুদ্ধ হই। পরে টিকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হই।
অপর এক ভুক্তভোগী জানান, সকাল থেকে ওদের মাইকিং শুনতাম। স্কুলগুলোতেও এর ক্যাম্পেইন চলত। ওদের একটা টিম থাকে। ওখানে যাওয়ার পর ওরা আমাদের কনভিন্স করে ফেলত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিন বছর ধরে জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্স বাংলাদেশে আমদানি বন্ধ রয়েছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জরায়ু ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন বানিয়ে বিক্রি করছে একটি চক্র। একটি ভ্যাকসিনের তিন ডোজ নিলে কখনই জরায়ু ক্যানসার হবে না-এই প্রচারণা চালিয়ে গাজীপুরে ছয় হাজারের বেশি নারীর দেহে তিনটি করে নকল ভ্যাকসিনের ডোজ দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাকসিনটি বানানো হয়েছে আমদানি নিষিদ্ধ হেপাটাইটিস-বির ভ্যাকসিন থেকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে চোরাইপথে হেপাটাইটিস-বির ভ্যাকসিন জিন ভ্যাক-বি নিয়ে আসে চক্রের সদস্যরা। চোরাইপথে এই ভ্যাকসিনের এক অ্যাম্পল বাংলাদেশে নিয়ে আসতে খরচ হয় ৩৫০ টাকা। একটি অ্যাম্পল খুলে ১০টি অ্যাম্পলে প্রবেশ করানো হয়। নতুন অ্যাম্পলগুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হয় জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্সের লেবেল।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি ভ্যাকসিন খুলে ১০টি ভ্যাকসিন বানালে এর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। এছাড়া ভ্যাকসিনের অ্যাম্পল খুলে অন্য অ্যাম্পলে প্রবেশ করানোর সময় নতুন করে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র জানায়, জরায়ু ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন সেরাভিক্সের প্রতিটি অ্যাম্পল বিক্রি করা হয় আড়াই হাজার টাকা করে। সম্প্রতি এ ধরনের একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। তারা হলেন-সাইফুল ইসলাম শিপন, ফয়সাল আহম্মেদ, আল আমিন, নুরুজ্জামান সাগর ও আতিকুল ইসলাম। এই পাঁচজন গ্রেফতার হওয়ার পর চক্রের অন্য সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘চক্রটি সুনির্দিষ্ট কিছু ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পেইন চালিয়ে জরায়ু ক্যানসারের নকল এই ভ্যাকসিনগুলো বিক্রি করেছে। রাজধানীর অন্তত ১৪৮টি স্কুলে নকল টিকা দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছি। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব টিকা দেওয়া হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে প্রতারণার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে। তারপরও বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এই ভয়াবহ প্রতারণার সঙ্গে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম সবুর যুগান্তরকে বলেন, নকল ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ভারত থেকে চোরাইপথে হেপাটাইটিস-বির ভ্যাকসিন জিন ভ্যাক-বি বাংলাদেশে নিয়ে আসেন সাইফুল ইসলাম শিপন। ফজর আলী নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ভ্যাকসিনগুলো সংগ্রহ করে ঢাকার দক্ষিণখান ও কেরানীগঞ্জে মজুত করা হয়। তিনি বলেন, দক্ষিণখানের সেলিনা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, আল নূর ফাউন্ডেশন, মিরপুর দারুস সালামের ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন ও চেরাগআলীর পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নকল জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিনগুলো বিক্রি করে আসছিল চক্রটি।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারুল ইকবাল বলেন, এ রকম ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটে। শাহেদ, ড. সাবরিনার ঘটনাগুলো দেখুন। শাহেদ-সাবরিনা থেকে শিক্ষা নিইনি আমরা। এগুলো থেকে শিক্ষা নিলে আমরা কেউ বিপদে পড়ব না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. সালাহউদ্দিন শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, তরুণীদের জরায়ু ক্যানসারের সারভারিক্স নামক নকল টিকা দেওয়ার ঘটনা অধিদপ্তর থেকে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিপ্তদরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি সব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও জেলা সিভিল সার্জন বরাবর পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি সারা দেশে আমাদের সার্ভিল্যান্স টিমকে কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও কারও কাছে সঠিক তথ্য থাকলে, তিনি অধিদপ্তরকে জানালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে অভিযান চালানো হবে।