Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যু

প্রত্যাহার করা হচ্ছে যুগ্মসচিব এনামুল হককে

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন, রাজশাহী ব্যুরো ও নওগাঁ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রত্যাহার করা হচ্ছে যুগ্মসচিব এনামুল হককে

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (বিতর্কিত যুগ্মসচিব) এনামুল হককে শিগগিরই প্রত্যাহার করা হচ্ছে।

ক্ষমতার অপব্যবহারসহ ব্যক্তিগত কাজে রাষ্ট্রীয় পদ-পদবি ব্যবহার এবং নিজ মন্ত্রণালয় বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করে তিনি সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি লংঘন করেছেন।

এ ছাড়া তার অভিযোগের ভিত্তিতেই একজন নারী কর্মচারী মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফলে এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও মনে করছে, একজন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার লোক এভাবে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীর সঙ্গে আচরণ করতে পারেন না।

তিনি নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে নওগাঁর সদর উপজেলার ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনকে র‌্যাবের হাতে তুলে দেন। মামলা ছাড়াই জেসমিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যু হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় যুগ্মসচিব এনামুল হকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এদিকে এনামুল হকের ক্ষমতার অপব্যবহারসহ আচরণবিধি লংঘনের দায়ে তার বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন যুগ্মসচিব (মাঠ প্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের শায়লা ফারজানা বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এনামুল হক প্রথমত একজন নাগরিক।

তারপর তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। নাগরিক হিসাবে তিনি যে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করতেই পারেন। তাতে আইনি কোনো বাধা নেই।

জেসমিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, তাই এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। তার (এনামুল হক) বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বৃহস্পতিবার (আজ) তা জানা যাবে বলে জানান তিনি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র জানায়, এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হচ্ছে। এজন্য পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। উচ্চ আদালত সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনাটি অধিকতর গুরুত্ব সহকারে আমলে নেওয়ায় মন্ত্রণালয়ও গুরুত্ব দিচ্ছে। একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, আদালত থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা জারির আগেই মন্ত্রণালয় এনামুল হকের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চায়।

অন্যদিকে র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে বলা হয়। এছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবিও জানানো হয়। বুধবার রাজধানীর লালমাটিয়ার আসক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ দাবি জানান সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন। তিনি বলেন, সুলতানা জেসমিনকে আটকের বিষয়ে থানা পুলিশ অবহিত ছিল না। এমনকি আটকের পরও নয়। এসব ঘটনায় সন্দেহ করার অনেক কারণ রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সুলতানা জেসমিনের পরিবার দাবি করেছে, র‌্যাব হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েই তার মৃত্যু ঘটেছে এবং তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন না। এছাড়া আটকের আগে তার মাথায় বা শরীরে কিংবা হাতের কোনো অংশে জখম বা আঘাতের চিহ্ন ছিল না। এ সময় আরও জানানো হয়, সুলতানা জেসমিনের আটকের ঘটনায় র‌্যাব-৫-এর সিপিসিতে কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) রাম বাবু রায় জব্দ তালিকা তৈরি করেন। সেখানে উল্লেখ আছে, একটি পুরোনো ব্যবহৃত রেডমি-১০ মডেলের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন সিমসহ জব্দ করা হয়েছে। অথচ পরিবারের অভিযোগ, সুলতানা জেসমিনকে আটকের সময় তার হাতের স্বর্ণ, চুড়ি, গলায় স্বর্ণের চেইন, কানে স্বর্ণের দুল ছিল। যা জব্দ তালিকায় নেই। এমনকি র‌্যাব বা কোনো পক্ষ থেকে এগুলো পরিবারকে ফেরতও দেয়নি। এসব ঘটনা পুরো একটি বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে এর দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করতে হবে বলে মনে করে আসক।

ব্যক্তিগত কাজেই এনামুল হক নওগাঁ যান : যুগান্তরের অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, রাজশাহী বিভাগী কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক ব্যক্তিগত কাজেই নওগাঁ গিয়েছিলেন। তিনি এর জন্য ঊর্ধ্বতন কারও অনুমতি নেননি।

তার ফেসবুক আইডি হ্যাকড করে চাকরি দেওয়ার নামে ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। এতে তিনি জড়িত করেন চাঁদপুরের হাইমচর থানার গাজীবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আল আমিন ও নওগাঁর সদর উপজেলার ভূমি অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে। ২৩ মার্চ রাতে রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।

যুগ্মসচিব এনামুল হকের দাবি অফিসের কাজে যাওয়ার পথে র‌্যাবের টহল দলের সঙ্গে তার হঠাৎ দেখা হয়েছিল। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের একটি সরকারি গাড়ি (রাজ মেট্রো-ঘ ১১-০১১৮) ব্যবহার করেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তার ট্রাভেল হিস্ট্রি লগবুকে উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু এনামুল হক তা করেননি। তার সরকারি গাড়ির চালক ইসরাইল হোসেন জানিয়েছেন, ওইদিন সরকারি কাজে গাড়িসহ এনামুল হককে নিয়ে তিনি নওগাঁ গিয়েছিলেন কি না-তা তার মনে নেই। গাড়ির লগবুক দেখাতে পারেননি তিনি। যুগ্মসচিব এনামুল হকও স্বীকার করেছেন তার সরকারি গাড়ির লগবুক প্রতিদিন লেখা হয় না। মাস শেষে একবারই ট্রাভেল হিস্ট্রি লেখা হয় লগবুকে। এনামুল হকের নওগাঁয় গমনের বিষয়ে নওগাঁ জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। নওগাঁ জেলা প্রশাসনের প্রটোকলের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ওইদিন এনামুল স্যার নওগাঁয় সরকারি কোনো কাজে এসেছিলেন বলে রেকর্ডে কিছু উল্লেখ নেই। নিয়মানুযায়ী যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার জেলায় আগমন ঘটলে তা জেলা প্রশাসনকে আগেই অবহিত করেন। ২২ মার্চও এনামুল হক নওগাঁয় যান। তখনো তিনি কাউকে কিছু অবগত করেননি। নওগাঁ জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ওইদিন এনামুল স্যারের কোনো দাপ্তরিক কর্মসূচি নওগাঁ জেলার কোথাও ছিল না বলে তারা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছেন। এই বিষয়ে যুগ্মসচিব এনামুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। নওগাঁর কোন সরকারি দপ্তরে তার সফরসূচি ছিল সেটাও তিনি বলতে পারেননি।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী ও র‌্যাবের জব্দ তালিকার সাক্ষীদের বর্ণনা : ঘটনার সময় উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করে জানান ‘জেসমিনকে ধরার ৩০ মিনিট আগে একইদিন আরও এক নারীকে উঠিয়ে নিতে চেয়েছিল র‌্যাব। তখন ওই নারী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে। তখন এলাকার মানুষ সবাই এগিয়ে গেলে ওই নারীকে আর র‌্যাব নিয়ে যায়নি। এরপর জেসমিন সুলতানাকে ওই পথে পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। আগে থেকে র‌্যাবের একটি মাইক্রোবাস মুক্তির মোড়ে অপেক্ষায় ছিল। আটকের কয়েকদিন আগে থেকেই জেসমিনের বাসার আশপাশে র‌্যাব সদস্যরা সাদা পোশাকে ঘোরাঘুরি করছিলেন।

গতকাল বুধবার সরেজমিন বিকাল ৩টায় ঘটনাস্থল নওগাঁ শহরের মুক্তি মোড়ে কল্পনা হার্ডওয়্যারের দোকানের সামনে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, র‌্যাবের জব্দ তালিকার একজন সাক্ষী যুগান্তরকে জানান, ঘটনার দিন সকাল ৯টার দিকে কল্পনা হার্ডওয়্যারের দোকান খুলে ভেতরে ছিলেন। তার প্রায় ২০ মিনিট পর আমার দোকানের সামনে কয়েকজন র‌্যাবের সদস্য মাস্ক পরিহিত এক নারীকে রিকশা থেকে নামানোর চেষ্টা করছেন। ওই নারী রিকশা থেকে নামতে চাচ্ছিলেন না। এ সময় র‌্যাবের দুজন নারী সদস্য জোর করে টেনে সাদা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেন। তখন ওই নারী বলছিলেন আমার অপরাধ কী? র‌্যাবের সদস্যরা বলছিলেন, স্যার তোর সঙ্গে কথা বলবেন। তাই নিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এ সময় সাদা কাগজের ওপর আমাকে স্বাক্ষর করতে বলেন একজন র‌্যাব সদস্য। আমি স্বাক্ষর দিতে চাইনি। তখন তারা বলে, স্বাক্ষর করলে সমস্যা নেই। তখন আমি একটি স্বাক্ষর করি। কী অপরাধে ওই নারীকে আটক করা হলো সে বিষয়ে কিছু বলেনি। পরে শুনলাম ওই নারী মারা গেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই নারীকে আটকের সময় স্থানীয় লোকজন বাধা দিয়েছিল। তখন র‌্যাবের লোকজন তাদের আইডি কার্ড দেখালে লোকজন দূরে সরে যান। আটকের সময় র‌্যাবের দুটি গাড়ি ছিল ঘটনাস্থলে। তার মধ্যে একটি সাদা মাইক্রোবাস। সাদা মাইক্রোবাসে ওই নারীকে তোলা হয়। গাড়িতে তোলার সময় ভয়ার্তভাবে চিৎকার করছিলেন ওই নারী। র‌্যাবের জব্দ তালিকার আরেক সাক্ষী বলেন, আমার ছেলে সুমন দর্জির দোকানে কাজ করেন। দোকানে যাওয়ার পথে র‌্যাব সাদা কাগজে তার স্বাক্ষর নেয়। এর বেশি কিছু নয়। সুমন কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো কোথাও আছে।

জেসমিনের ময়নাতদন্তে অগ্রগতি নেই : সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরিতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মৃত্যু সনদে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং হার্টফেল মৃত্যুর কারণ বলে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। এজন্য জেসমিনের হার্টও সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্যাথলজি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সবগুলো রিপোর্ট পেলে আমরা তিনজন চিকিৎসক বসে এক এবং অভিন্ন মতামত দেব। তখন মতামতসহ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় আরও চার-পাঁচ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ২২ মার্চ নওগাঁ শহরের জনকল্যাণপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুলতানা জেসমিনকে আটক করে র‌্যাব। এরপর অসুস্থ অবস্থায় তাকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতালে এবং পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন শুক্রবার সকালে মারা যান জেসমিন। আটকের পর র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম