ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে বক্তৃতা
সম্মানি নিতে পারবেন না সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা
ইসির অনুরোধ রাখেনি অর্থ মন্ত্রণালয় * ‘বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক পদধারীরা দায়িত্ব পালনে প্রিভিলেজ অ্যাক্টের বাইরে সুবিধা প্রাপ্য নন’
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বক্তাদের সম্মানি বহাল রাখতে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ রাখেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। উলটো জানিয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা প্রিভিলেজ অ্যাক্টের বাইরে কোনো সম্মানি বা আর্থিক সুবিধা পাবেন না। নির্বাচন পরিচালনা করা কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এ দায়িত্বেরই অংশ। প্রশিক্ষণের জন্য তারা কোনো সম্মানি প্রাপ্য হবেন না। এমনকি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হিসাবে অংশ নিলে সেজন্যও তারা কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না। ১৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাচান কমিশন সচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে এসব কথা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও নির্বাচন কমিশন ওই চিঠি ২২ ফেব্রুয়ারি পেয়েছে। চিঠিতে কোর্স পরিচালক, কোর্স সমন্বয়ক ও সাপোর্ট স্টাফরা প্রশিক্ষণ ভাতা পাবেন না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, অর্থ বিভাগের উপসচিব মোছা. নারগিস মুরশিদা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে পাঁচটি মতামত দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগসহ অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীরা বিচারকার্য পরিচালনা বা সংবিধানের আওতায় অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রিভিলেজ অ্যাক্টের বাইরে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্য নন।’ এতে আরও বলা হয়, ‘সাংবিধানিক পদধারীরা যে কাজের জন্য সংবিধানের আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত, সেই কাজ বা সেই কাজসংশ্লিষ্ট কোনো দায়িত্ব পালনের জন্য প্রিভিলেজ অ্যাক্টের আওতায় সুবিধা প্রাপ্য হন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম সোমবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের ভাতাসংক্রান্ত বিষয়টি আমি ইসি সচিব হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার আগ থেকে আলোচনা হয়ে আসছে। এ বিষয়ে আমি নথিপত্র না দেখে বলতে পারব না। ওই চিঠি পেয়েছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার স্মরণে নেই।
তবে নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, তারা ওই চিঠি পেয়েছেন। চিঠির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত পেলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে ইসির প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ইসি সূত্র জানায়, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর আগ থেকেই নির্বাচনি প্রশিক্ষণ থেকে কোনো সম্মানি গ্রহণ করেন না। বাকি তিনজন নির্বাচন কমিশনার ওই সম্মানি নিয়ে আসছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ চিঠির ফলে তাদের সম্মানি নেওয়ার পথ বন্ধ হলো। শুধু তাই নয়, ১০ অক্টোরব থেকে এ পর্যন্ত তারা যে পরিমাণ ভাতা নিয়েছেন, তা নিয়ে অডিট আপত্তিও আসতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইসির বরাদ্দকৃত টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হবে, তা ইসির এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর ৭ ও ১৬ ধারায় নির্বাচন কমিশনকে এ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির মাধ্যমে ওই স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনারদের জন্য পৃথক কোনো প্রিভিলেজ অ্যাক্ট নেই। তারা উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন। তারা জানান, বিগত কেএম নূরুল হুদা কমিশনের এক সভায় নির্বাচনি প্রশিক্ষণে বক্তাদের পদ অনুযায়ী ভাতা অনুমোদন করা হয়। ওই হার অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ভাতা দেওয়া হচ্ছে। যদিও বক্তৃতার জন্য ওই ভাতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তখন ইসির সচিব ছিলেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ভাতার হার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন করানোর প্রস্তাব দেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। এ পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার এবং ইসির কর্মকর্তাদের পদ অনুযায়ী ভাতা অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওই প্রস্তাবে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি দেড় ঘণ্টার সেশনে ৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিবদের ভাতা ৫ হাজার টাকা ধরা হয়। অন্য কর্মকর্তাদের ভাতা আরও কম ধরা হয়। এর জবাবে ১০ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের ভাতা কেটে দেয়। অন্য কর্মকর্তাদের ভাতার হার কমিয়ে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এক চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার বা সংশোধনের অনুরোধ জানায়। এর জবাবে অর্থ মন্ত্রণালয় আবারও তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।
সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের সম্মানির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের আলোকে নির্বাচন পরিচালনা করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসাবে গণ্য হবে বিধায় নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মচারীদের নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা মাঠপর্যায়ে ব্রিফ করা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা কোনো সম্মানি বা আর্থিক সুবিধা পাবেন না। এতে আরও বলা হয়, নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের রুটিন দায়িত্ব বিধায় কোর্স পরিচালক, কোর্স সমন্বয়ক বা সাপোর্ট স্টাফরা সম্মানি প্রাপ্য হবেন না। এছাড়া ১০ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় যে ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা বহাল আছে বলেও জানানো হয়।
সূত্র আরও জানায়, অক্টোবরের চিঠিতে সিনিয়র সচিব, সচিব বা অতিরিক্ত সচিব প্রতি দেড় ঘণ্টার সেশনের জন্য তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও ইসি সচিবালয় ওই ভাতা পাঁচ হাজার টাকা চেয়ে আসছে। যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য ইসি ৩ হাজার টাকা চাইলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতা ৫০০, তাদের দুপুরের খাবার ৪০০ এবং চা-নাশতা বাবদ ৪০ টাকা হারে নির্ধারণ করেছে।