Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ

বিভীষিকা ভুলতে পারছেন না ভাগ্যবানরা

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিভীষিকা ভুলতে পারছেন না ভাগ্যবানরা

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে কুইন টাওয়ারে বিস্ফোরণ। ছবি: যুগান্তর

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে কুইন টাওয়ারে বিস্ফোরণে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন ভাগ্যবান অনেক মানুষ। ভয়ংকর সেই স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তারা। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরা মানুষগুলো বলছেন, তারা যেন দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন। দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাদের অনেকেই শিউরে ওঠেন।

ইমন মিয়া (২৩)। সিদ্দিকবাজারে আলামিন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি চাবির দোকানে কাজ করেন। বিস্ফোরণে ধসে পড়া ভবনের একটি দোকানে কাজ করতেন তারই বন্ধু সুমন। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সুমন তাকে ফোন দিয়ে চা-পান করতে ডাকেন। নিচে নেমে দুজন বিস্ফোরিত ভবনের বিপরীত পাশের একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন আর গল্প করছিলেন। ইমন বলেন, হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো। কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। মুহূর্তেই ধুলায় সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। সিনেমায় এমন দৃশ্য দেখেছি-মানুষ বাঁচার জন্য প্রাণপণ ছুটতে থাকে। আল­াহকে ডাকতে ডাকতে আমিও দৌড়াতে থাকি। একজনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মুখে আঘাত পাই। তবে আমার ভাগ্য ভালো যে, বেঁচে গেছি। দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। পরে শুনি বন্ধু সুমন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ইমন বলেন, এই বিভীষিকা চোখ থেকে কোনোভাবেই সরাতে পারছি না। কথা বলতে বলতে যেন দম আটকে আসছিল ইমনের।

সদরঘাট থেকে সাভার পরিবহণে পল্টনের বাসায় ফিরছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, গুলিস্তানের কিছুটা আগে যানজটে বাস ধীরগতিতে চলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দ হলো, মুহূর্তেই বাসের জানালার কাচ ভেঙে পড়ল যাত্রীদের গায়ে। রক্তে রঞ্জিত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন বাসের অনেক যাত্রী। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। মানুষের বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ আর ছোটাছুটিতে মনে হয়েছিল দুনিয়া শেষ। কেয়ামত নেমে এসেছে। তিনি বলেন, আমি বাসের মাঝখানে ডানপাশে বসা ছিলাম। আমার হাতে একটা কাচের টুকরা লেগে কেটে গেছে। হাত কাটলেও বড় ধরনের বিপদ থেকে যে আল­াহ রক্ষা করেছেন, এজন্য হাজার শুকরিয়া। তিনি বুধবার ঘটনাস্থলে ছুটে যান সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখতে।

বাসের আরেক যাত্রী কামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ বিস্ফোরণ হলে বাসের ওপর এসে পড়ে ভবনের ভাঙা অংশ, কংক্রিট ও ধাতব টুকরো। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। কিছুই মনে করতে পারছি না এরপর কী হয়েছে। জ্ঞান ফিরতেই দেখি বাসটি চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে গেছে। ৩০-৪০ জন আহত হয়েছেন। মারাও গেছেন কেউ কেউ।

ঘটনাস্থলের উলটো পাশের একটি বিদ্যুতের খুঁটির নিচে পান-সিগারেট বিক্রি করেন ফয়েজ মিয়া (৩০)। তবে দোকান বন্ধ রেখে ঘটনাস্থলে দিনভর অবস্থান করছিলেন ফয়েজ। এই বিস্ফোরণের অন্যতম প্রতক্ষ্যদর্শী তিনি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি। ফয়েজ যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৫টা। একজন কাস্টমার ৫টা সিগারেট চাইলেন। আমি তাকে সিগারেট দিচ্ছিলাম আর কথা বলছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ। চারদিক ধুলায় অন্ধকার হয়ে এলো। এর মধ্যে বৃষ্টির মতো পড়তেছে কাচ ও ইটের টুকরা। সবাই ছোটাছুটি করছিল। আমি কোনোদিকে না দৌড়ে মাটিতে শুয়ে পড়ি। ৫-৬ মিনিট পরে উঠে দ্রুত দোকান বন্ধ করি। এরপর যা দেখলাম, জীবনে কোনোদিন এমন দৃশ্য দেখিনি। চারদিকে শুধু বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। শুধু রক্ত আর রক্ত। রাস্তার পথচারী; রিকশা, ভ্যান ও পরিবহণের যাত্রী-সবাই আহত হয়েছেন। কেউ কেউ ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। এরপর যতটুকু পারছি মানুষকে সাহায্য করে পিকআপ, অ্যাম্বুুলেন্স ও ভ্যানে তুলে দিয়েছি।

তিনি বলেন, দেখলাম মাথায় গ্লাস পড়ে দুইভাগ হয়ে গেছে এক বাদাম বিক্রেতার। তার পাশেই পড়েছিল বাদামের ঝুড়িটি। পরে লাশ উদ্ধার করে মেডিকেলে নেওয়া হয়।

কুইন টাওয়ারের দক্ষিণ পাশের ভবনে জুতার গুদাম দেখভাল করেন মঞ্জুর হোসেন। বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস আসার আগে ৩০ জনের মতো আহত ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে যুক্ত ছিলেন তিনি। মঞ্জুর যুগান্তরকে বলেন, আমিসহ কয়েকজন মিলে অন্তত ৩০ জনকে উদ্ধার করেছি। কয়েকজনের পুরো শরীর রক্তমাখা ছিল। শরীরের কাপড় ছিঁড়ে গেছে, কারওবা পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে আমি এই ভবনে একটা কাজে এসে ঘুরে গেছি। আল­াহ আমাকে রক্ষা করেছেন। আমিও লাশ হতে পারতাম।

দুর্ঘটনায় বিস্ফোরিত ভবনের পাশেই ‘কাদের ম্যানশন’। এই ভবনের নিচতলায় ইউসুফ স্যানিটারির মালিক মো. নুরু ও তার কর্মচারী ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। ভবন মালিক সরফুদ্দিন ভ‚ঁইয়া সেন্টু বলেন, আমি নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় ঢোকার আগেই বিকট শব্দ হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম ভ‚মিকম্প হচ্ছে। মানুষের হুড়োহুড়ি দেখে মনে হচ্ছিল কেয়ামতের মাঠ। রাস্তায় মানুষের তাজা রক্ত। কোথাও লাশ পড়ে আছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে আহত মানুষের আর্তনাদ। তিনি জানান, ‘ইউসুফ স্যানিটারির’ মালিক মো. নুরু ইম্পোর্টার ছিলেন। পাওনা টাকার তাগাদা দিতে তিনি ওই ভবনে গিয়েছিলেন। নুরুর এক কর্মচারী ওই সময় রাস্তা দিয়ে দোকানের দিকে আসছিলেন, তিনিও ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।

সিদ্দিকবাজারে কুইন টাওয়ারে বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। আর আহত একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এছাড়া দুই শতাধিক আহত মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম