Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

দুই যুগেও পায়নি পূর্ণাঙ্গ রূপ

সম্প্রতি নেওয়া হয়েছে কিছু কর্মসূচি এখনো মূল কাজ থেকে অনেক দূরে

Icon

মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুই যুগেও পায়নি পূর্ণাঙ্গ রূপ

বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই)। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করে ১৯৯৯ সালে। এরই প্রেক্ষাপটে এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের পট পরিবর্তনে শুরুতে এর যাত্রা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। যদিও ২০০৯ সালে নতুন সরকারের আগমনে সঞ্জীবনী শক্তি পায়। নির্মাণকাজ শেষে যাত্রা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু বিগত এক যুগে স্বাভাবিক গতি আর ফিরে পায়নি। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি প্রতিষ্ঠানটি।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন মাতৃভাষাচর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইনস্টিটিউট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, আইএমএলআই প্রতিষ্ঠাকালে ২৩টি কাজ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেগুলোর মাত্র ৫টি পুরোপুরি এবং কয়েকটি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষা প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ। পাশাপাশি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ। কিন্তু বিদেশে বাংলা প্রসারে অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি তেমন কোনো পদক্ষেপ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অভ্যন্তরীণ কিছু কর্ম আর পদক্ষেপ এবং একুশে উদযাপনের কর্মসূচির মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে কার্যক্রম। এছাড়া প্রায় ৭ বছর আগে ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’ করা হয়েছিল। এর ওপর দশটি গ্রন্থ প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে একটি। বাকি নয়টি আর কোনোদিন প্রকাশিত হবে কি না, সেটিও নিশ্চিত নয়।

প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি মহাপরিচালক। শুরু থেকে ওই পদ অলংকৃত করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী। ২০২১ সালের নভেম্বরে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর প্রায় ৫ মাস ওই পদে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে মহাপরিচালকের পদ অলংকৃত করেন। পরে গত ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগ পান। তরুণ এই অধ্যাপক অবশ্য দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই একটি ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করেন।

গ্রহণ করেন বেশকিছু সৃজনশীল পদক্ষেপ। কিন্তু এক যুগ ধরে স্থবির করে রাখা প্রতিষ্ঠানকে তিনি এখনো গতি দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী জনবল সংকট অন্যতম প্রধান বাধা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটিতে স্থায়ী কর্মকর্তা নিয়োগের কথা থাকলেও শিক্ষা ক্যাডার থেকে ধার করা কর্মকর্তা দিয়েই চলছে।

এককথায় বলতে গেলে, তাদের ডাম্পিং আর ঢাকা বসবাসের পোস্টিং কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আবার যাদের প্রেষণে নিয়োগ করা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশের নেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক জ্ঞান আর দক্ষতা।

সব মিলে জনবল কাঠামোতে ৯৩ জন থাকার কথা। সেগুলোরও বেশির ভাগ পদ শূন্য। আবার প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী করতে নতুন জনবল কাঠামো তৈরির কথা। সেই প্রস্তাবেরও প্রশাসনিক অনুমোদন মেলেনি।

সব মিলে অনেকটা গতিহীন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে আইএমএলআই। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, আজকের অমর একুশে, মহান শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে খুবই ব্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দিবসটি উপলক্ষ্যে আজ অপরাহ্নে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাশাপাশি তিনি নবরূপে সজ্জিত মাতৃভাষা জাদুঘর উদ্বোধন করবেন। তাই দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত মিলনায়তন আর জাদুঘর ঘিরে ছিল এই ব্যস্ততা। ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয়োজন করা হবে যথাক্রমে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সেমিনার, ভাষামেলা ও শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। মেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অংশ নেবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক হাকিম আরিফ যুগান্তরকে বলেন, এক যুগ বয়সি হিসাবে এই প্রতিষ্ঠানের অর্জন প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই-এমন অভিযোগ অস্বীকার করা যাবে না।

কর্মসূচি আর কাজের অভাবে বরাদ্দ অর্থ একসময় ফেরত যেত। তবে আমি যোগ দেওয়ার পর কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এখন বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন হচ্ছে। আসলে পৃথিবীর দেশে দেশে ভাষার প্রচার ও প্রসার অত সহজ কাজ নয়।

যদি সহজই হতো, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাব ও পরাক্রমশালী দেশ ও জাতির ভাষার প্রচার আর বিস্তৃতি আরও দেখা যেত। তবে এরপরও আইএমএলআই ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে।

এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মহাপরিচালক বেলায়েত হোসেন তালুকদার। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আইএমএলআই এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের দ্বিতীয় গ্রেডের প্রতিষ্ঠান।

প্রথম শ্রেণির প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার ব্যাপারে তাদের যেসব শর্ত আছে, তা মানতে গেলে আমাদের স্বকীয়তার সঙ্গে আপস করতে হবে। তবে কর্মসূচির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ সম্ভব হলে সারা বিশ্বে ইউনেস্কোর মতোই একটি প্রতিষ্ঠানে একদিন আইএমএলআই পরিণত হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কাজ না থাকায় প্রায় সারা বছরই অনেকটা ঝিমিয়ে আর ঘুমিয়ে কেটে আসছিল এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়। দৈনন্দিন বড় কাজের মধ্যে আছে শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী আর সচিবকে স্বাগত জানানো।

কেননা বর্তমান মন্ত্রী ডা. দীপু মনি দায়িত্ব গ্রহণের পর আইএমএলআই-এর পঞ্চমতলায় নিজের একটি অফিস স্থাপন করেছেন। পাশাপাশি উপমন্ত্রী ও সচিবেরও দপ্তর আছে। তারা গেলে তখন ভবনটি কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের আরেক তলায় স্থাপন করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির কার্যালয়। এসব কারণেও সেখানে মাঝেমধ্যে লোকসমাগম দেখা যেত। 

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন মহাপরিচালক বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজটি হচ্ছে ‘বহুভাষী পকেট অভিধান’। বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি ১৬টি ভাষায় প্রকাশ করা হবে এটি। অন্য ভাষাগুলো হচ্ছে-জার্মান, রুশ, স্প্যানিশ, আরবি, ফারসি, তুর্কি, হিন্দি, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ, ফরাসি, চায়নিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান এবং বাহাসা মালয়েশিয়া।

বাংলা-ইংরেজির পাশাপাশি অন্য তিনটি ভাষা থাকবে প্রত্যেক অভিধানে। মহাপরিচালক বলেন, এগুলো প্রণয়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি ও শিক্ষার্থীরা যেসব দেশে বেশি গমন করে, সেগুলোর আধিক্য বিবেচনায় ভাষাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যাবহারিক শব্দগুলো থাকবে এসব অভিধানে, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে প্রাথমিক ভাষাগত যোগাযোগ চালিয়ে নিতে পারে।

এছাড়া নতুন কর্মসূচির মধ্যে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অভিধান প্রকাশ করা। প্রাথমিকভাবে ‘ঠার-বাংলা অভিধান’ (বেদেগোষ্ঠী) শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হচ্ছে যার কাজ শেষ পর্যায়ে আছে।

এছাড়া সম্প্রতি অনুবাদ শাখা খোলা হয়েছে। সেখান থেকে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভাষাগুলো হচ্ছে-চাকমা, মারমা, গারো, কুড়মালি, ককবক ও সাদরি।

এছাড়া বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পের অনুবাদ ‘দ্য ওয়ান আইড উইচ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ বাই হুমায়ূন আহমেদ’ প্রকাশিত হবে। এই উভয় ধরনের গ্রন্থ মুদ্রণের জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ৬ খণ্ডে মাতৃভাষাপিডিয়া প্রণয়নের কাজ চলছে। 

তবে বর্তমান প্রশাসনের অন্যতম আকর্ষণীয় উদ্যোগ হচ্ছে ভাষা জাদুঘর নবরূপে প্রতিষ্ঠা। আগে ১১০টি দেশের প্রোফাইল থাকলেও এখন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ২১০টি দেশই এতে স্থান পেয়েছে।

প্রত্যেক দেশকে একটি করে পোট্রেটে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট দেশের দাপ্তরিক ভাষা, বিদ্যমান বা জীবিত ভাষার সংখ্যা, প্রধান ভাষা, প্রধান ভাষার নমুনা বাক্য ও ইংরেজিতে এর অনুবাদ এবং পৃথিবীর মানচিত্রে অবস্থানসহ ওই দেশের প্রধান স্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

যেমন: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধান স্থাপনা হিসাবে জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের ছবি দেওয়া হবে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে-বাংলা ভাষার উৎপত্তি, প্রধান ভাষা সংখ্যা, উৎপত্তি ম্যাপ, এশিয়ার প্রধান ভাষা, পৃথিবীর প্রধান ভাষা পরিবার তুলে ধরা। এছাড়া আছে মহান ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

ভাষা সম্পর্কে জ্ঞানপিপাসুদের এই জাদুঘর বেশ খোরাক দেবে বলে মনে করেন ভাষাবিজ্ঞানী ড. হাকিম আরিফ। তিনি বলেন, এমন একটি জাদুঘর যে দেশে আছে, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এই জাদুঘরের প্রধান দর্শক হবে শিক্ষার্থীরা। তাদের নিয়ে যেন শিক্ষকরা পরিদর্শনে আসেন, সেই লক্ষ্যে চিঠি পাঠানো হবে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম