Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আসামি ছেড়ে দিতে অভিনব মুক্তিপণ

ডাকাতদের ৬ স্ত্রীর কাছ থেকে ডিবি টিমের ঘুস বাণিজ্য

ঘটনা জানাজানি হলে মুক্তিপণের এক কোটি ৪২ লাখ টাকা ডিবিকে বাদী দান করেছেন মর্মে স্ট্যাম্পে লিখে নেওয়া হয়

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডাকাতদের ৬ স্ত্রীর কাছ থেকে ডিবি টিমের ঘুস বাণিজ্য

আটক করা ছয় ‘ডাকাত’কে ছেড়ে দিতে চান সংশ্লিষ্ট ডিবি টিমের সদস্যরা। কিন্তু বিনিময়ে দিতে হবে দুই কোটি টাকা। তবে তাদের স্ত্রীরা এত টাকা দিতে অপারগ। একপর্যায়ে দফারফা হয় এক কোটি ২৮ লাখে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গুনতে হয় আরও ১৪ লাখ। এভাবে মুক্তিপণের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয় এক কোটি ৪২ লাখে। অবিশ্বাস্য হলেও চাঞ্চল্যকর এমন গুরুতর অপরাধে যুক্ত হয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম। ইতোমধ্যে অভিযোগটি প্রমাণিত হয়েছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে। ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে একজন এডিসি, দুজন পরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট ডিবি টিমের সাত সদস্যকে। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা পর্যন্ত করা হয়নি।

এদিকে টাকা আদায়ের ঘটনা জানাজানি হলে ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এরই অংশ হিসাবে মামলার বাদীর কাছ থেকে একটি স্ট্যাম্পে লিখিত নেন। যেখানে লেখা আছে, ‘আমার (বাদী) করা মামলায় এক কোটি ৪২ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে ডিবি। আমি খুশি হয়ে পুরো টাকা ডিবিকে দান করলাম।’ দীর্ঘদিন ধরে মামলার বাদী রোমান মিয়া নিরুদ্দেশ থাকায় এ বিষয়ে বাদীর বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোমান মিয়া এখন দুবাই অবস্থান করছেন।

এদিকে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুলিশের একজন এসআই রয়েছেন। নাম আকসাদুদজামান। তিনি এ সংক্রান্ত ডাকাতির মামলায় সাড়ে সাত মাস জেলও খাটেন। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সিআইডি’র সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। এছাড়া স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয় ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট।

ডিবি পুলিশের এমন গুরুতর অপরাধের বিষয়টি সামনে আনেন আকসাদুদজামান। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ২০২১ সালের ২২ আগস্ট। মন্ত্রণালয় থেকে একজন উপ সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ওই বছর ৯ নভেম্বর। রিপোর্ট দেওয়া হয় প্রায় এক বছর পর ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে। এই কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে কিনা তা জানা সম্ভব হয়নি। রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় সংশ্লিষ্ট ডাকাতির মামলাটি হয় ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর। এ মামলায় ৯ জনকে অভিযুক্ত করে ডিবি পুলিশ চার্জশিট দেয় গত বছর ২২ মে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ রোববার তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ডিবি প্রধান ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’

পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) কামরুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিবি কার্যালয়ে ঘুস লেনদেন এবং এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আমি অবহিত নই।’

মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে ডিআইজি (প্রশাসন) খন্দকার লুৎফুল কবির যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আগে আমার অধীনে ছিল। এখন এটি ডিআইজির (হেডকোয়ার্টার্স) অধীনে চলে গেছে। তাই আমি এ নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’

ডিআইজি (হেডকোয়ার্টার্স) এসএম মোস্তাক আহমেদ খান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না। শুধু ডিবি নয়, যে কোনো পুলিশ সদস্য অপেশাদার কাজে জড়িত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিবি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা হয়ে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডিবি পরিচয়ে চার লাখ ৭৮ হাজার টাকার মালামাল লুটের অভিযোগে তিন বছর আগে জনৈক রোমান মিয়া বাদী হয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯ অক্টোবর ফুফাতো ভাই মনির হোসেনকে নিয়ে সকাল পৌনে সাতটার দিকে তিনি টিকাটুলির বাসা থেকে বিমান বন্দদের উদ্দেশে রওয়ানা হন। কাওলা ফুট ওভারব্রিজের নিচে পৌঁছলে একটি মাইক্রোবাস তাদের সিএনজির গতি রোধ করে। এসময় গাড়ি থেকে দুজন লোক নেমে ডিবি পরিচয়ে রোমানকে হ্যান্ডকাফ পরায় এবং কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। মারধর করে তার কাছে থাকা পাঁচ হাজার ইউএস ডলার, দুই হাজার দিরহাম, দুই হাজার টাকা, দুটি মোবাইল ফোন এবং সঙ্গে থাকা লাগেজটি ছিনিয়ে নেয়। সকাল ৯টার দিকে হ্যান্ডকাফ খুলে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে রামপুরা-স্টাফ কোয়ার্টারের রাস্তায় ফেলে দেয়।

রোমানের করা মামলাটির প্রাথমিক তদন্ত করেন বিমানবন্দর থানার এসআই কবির হোসেন। পরে তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবিকে। ডিবি তদন্ত শুরুর পর থেকে শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। ডিবির চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- পুলিশের (সিআইডি) এসআই আকসাদুদজামান (বরখাস্ত), মোশারফ হোসেন, সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন, রিজু মিয়া সিকদার, হাসান রাজা, মিলন মোড়ল ও মনির হোসেন।

যেভাবে ডাকাতদের স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা আদায় : ডিবি সদস্যরা ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর আকসাদুদকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে ডাকাতির মামলায় আগে থেকেই আটক করে রাখা হয় সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন, রিজু মিয়া, গোলাম মাওলা এবং হারুন আর রশিদকে। আকসাদুদজামানকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর এডিসি লাকী এবং এডিসি রিজভী অ্যাডিশনান ডিআইজি (ডিবির তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার) মাহবুব আলমের কাছে নিয়ে যান। এ সময় যুগ্ম কমিশনারকে জানানো হয়, বিমানবন্দর থানার ডাকাতির মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে জড়িত বলে স্বীকার করেছে।

তখন আকসাদুদজামান ডিবি কর্মকর্তা মাহবুব আলমকে জানান, ছিনতাইয়ের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। পরে ওইদিনই আকসাদুদজামানের মোবাইল থেকে ফোন করে মোশারফকে (আসামি) ডেকে কাকরাইলের এসএ পরিবহণের সামনে আসতে বলা হয়। মোশারফ সেখানে এলে কায়সার রিজভী কুরাইশির নেতৃত্বে ডিবি সদস্যরা তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ডিবি অফিসে নিয়ে আসেন। আকসাদুদজামানকে নিয়েই কাকরাইলে অভিযানে গিয়েছিল ডিবির টিম। অভিযোগ রয়েছে-অভিযান শেষে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আকসাদুদজামানের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে আকসাদ ও আটক অন্যদের কাছে দুই কোটি টাকা দাবি করেন এডিসি কুরাইশি। এই টাকা দিতে পারলে তিনি ‘স্যার’দের সঙ্গে আলোচনা করে সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দেন।

এ সময় এডিসি কুরাইশির নির্দেশে আকসাদ তার মোবাইল ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে টাকা জোগাড় করার কথা বলেন। টাকার ব্যবস্থা করতে আটক অন্যদের সঙ্গেও আকসাদুদজামানকে আলোচনার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কুরাইশির দাবি করা টাকার মধ্যে কে কিভাবে কত দিতে পারবেন তা নিয়েও আলোচনা হয়।

আলোচনার পর সবার মোবাইল ফোন দিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ সময় ডিবির এএসআই প্রকাশ এবং জুলহাস উপস্থিত ছিলেন। কথা বলার পর ডাকাতদের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা সংগ্রহ করতে বলা হয়। এরপর মোশারফের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ, সেলিম মোল্লা সাড়ে ৩৭ লাখ, রিপন মোড়ল চার লাখ, রাজু মিয়া সাত লাখ, আমির হোসেন সাড়ে ১৩ লাখ এবং আকাসাদুদজামানের স্ত্রীর পক্ষ থেকে ৩৩ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে ডিবি পুলিশের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকের টাকা একত্র করে একটি ব্যাগে ভরে আকসাদুদজামানের বাসায় পাঠানো হয়। এরপর ওই টাকা আনতে এডিসি কুরাইশির নেতৃত্বে ডিবির টিম ওই বাসায় যায়। সঙ্গে ছিলেন আকসাদুদজামান। বাসা থেকে মোট এক কোটি আটাশ লাখ টাকা নগদ বুঝে নিয়ে ডিবি টিম অফিসে ফিরে আসে। এরপর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার কথা থাকলেও ডিবি ইউটার্ন নেয়।

কাউকে না ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে আকসাদুদজামানকে এডিসি কুরাইশি জানান, টাকাগুলো সবাই (ডিবি কর্মকর্তারা) ভাগ করে নিয়ে গেছেন। তার ভাগে কম পড়েছে। তাকে ব্যক্তিগতভাবে আরও ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। তা না হলে কাউকেই ছাড়া হবে না। এরপর বাধ্য হয়ে ২৮ নভেম্বর আকসাদুদজামানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন আরও ১৪ লাখ টাকার ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডির জিগাতলায় গিয়ে কুরাইশিকে এই টাকা সরাসরি দেন আকসাদুদজামানের স্ত্রী তাহমিনা।

এদিকে সকালে টাকা পাওয়ার পর ওইদিন বিকালেই সিআইডির এএসপি ইকবাল হোসেন ডিবি কার্যালয়ে গেলে আকসাদুদজামানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে সকালে ছেড়ে দেওয়ার জন্য জিম্মানামা লিখতে বলা হয়। অবশ্য বিকালে ছেড়ে দেওয়ার সময় জিম্মানামা নেওয়া হয়নি।

যে কারণে জেলে আকসাদুদজামান : অনুসন্ধানে জানা যায়, আকসাদুদজামানকে যেদিন ছেড়ে দেওয়া হয় সেদিন গোলাম মাওলাকেও ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্যদের আদালতে চালান দেওয়া হয়। যাদের চালান দেওয়া হয় তাদের পরিবারের লোকজন আকসাদুদজামানের কাছে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তাই এডিসির কাছে টাকা ফেরত চান আকসাদুদজামান। তিনি কিছু টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা দেননি। এ সংক্রান্ত কল রেকর্ড যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে (যা সিআইডির পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে)। একপর্যায়ে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন আকসাদুদজামান। তিনি ডিবি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন। এ অভিযোগ দায়েরের পরপরই ৮ সেপ্টেম্বর তাকে ডাকাতির মামলায় জেলে পাঠানো হয়। এর সাড়ে সাত মাস পর ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।

পদে পদে অসঙ্গতি : ডাকাতি মামলার আসামি গ্রেফতার থেকে শুরু করে চার্জশিট দেওয়া পর্যন্ত পদে পদে দেখা দিয়েছে অসঙ্গতি। নথি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, আসামি হাসান রাজার জবানবন্দিতে ডাকাতির ঘটনায় আকসাদুদজামানের নাম এসেছে। সে অনুযায়ীই তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু যে জবানবন্দির ভিত্তিতে আকসাদুদজামানকে গ্রেফতার করা হয়, সেই জবানবন্দি নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। ডাকাতি মামলায় আকসাদুদজামানকে জড়িয়ে হাসান রাজা জবানবন্দি দেন ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি। কিন্তু এর দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৫ জানুয়ারি কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন জানান। ওই আবেদনে তিনি জানান, ডিবি কর্মকর্তারা আমাকে গ্রেফতারের পর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় বৈদ্যুতিক শক দেয়। তাদের শিখিয়ে দেওয়া কথা অনুযায়ী স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিতে চাপ দেয়। ভয় দেখিয়ে নির্যাতন চালিয়ে ডিবি কর্মকর্তারা আমার জবানবন্দি নিয়েছেন।

জবানবন্দিতে হাসান জানান, ঘটনার দিন দুজন ব্যক্তিকে (রোমান এবং মনির) তারা সিএনজি থেকে হাইয়েস গাড়িতে তুলে নেন। অন্যদিকে এজাহারে বাদী বলেন, ডাকাতরা তাকে (রোমান) একাই হাইয়েস গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেছে। হাসানের জবানবন্দি অনুযায়ী, মোশারফ তাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে যান। ঘটনা শেষে মোটরসাইকেলে মোশারফ তাকে খিলগাঁও তালতলা এলাকায় নামিয়ে দেন।

অন্যদিকে হারুনের জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘ঘটনার সময় আকসাদুদ ও মোশারফ তার হাইয়েস গাড়িতে ছিলেন। যে গাড়িটি সিআইডির মাধ্যমে ভাড়ায় চালিত হয়। তিনি (হারুন) ওই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। ঘটনার পর তিনি দুজনকে মালিবাগ সিআইডি অফিসের সামনে নামিয়ে দেন।’ তাই ঘটনার দিন মোশারফের অবস্থান মোটরসাইকেল না গাড়িতে ছিল-তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, দুজনের জবানবন্দিতে দুই ধরনের তথ্য এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে হাইয়েস গাড়ি (ঢাকা মেট্রো চ ১৯-২২৩৭) দিয়ে ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই গাড়িচালককে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর আটক করে ডিবি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তখন গাড়ি চালককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ১১ মাস পর যখন আকসাদুদজামানকে গ্রেফতার করা হয় তখন সেই গাড়ি পুনরায় জব্দ দেখানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, জব্দকৃত গাড়িটি ফের জব্দ করে মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এই মামলার সঙ্গে আকসাদুদজামান প্রকৃত অর্থে সম্পৃক্ত কিনা সে বিষয়ে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আসামি মোশারফকে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর কাকরাইল থেকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে আদালতে হাজির করা হয় ২৯ নভেম্বর। আদালতে হাজিরের পর ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয় তাকে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বাদী দুবাই যাওয়ার প্রাক্কালে এয়ারপোর্টের কাছে দুষ্কৃতকারীদের কবলে পড়েন। দুষ্কৃতকারীরা তার কাছ থেকে ইউএস ডলার এবং দিরহাম নিয়ে গেছে। কিন্তু পাসপোর্টে কোনো ডলার এনডোর্সমেন্ট করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্টটি জব্দ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

যারা দায়ী : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে ঘুস আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে তারা হলেন-ডিবির এডিসি কায়সার রিজভী কুরাইশি, পুলিশ পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান, এসআই মাসুদুল ইসলাম, এএসআই প্রকাশ চন্দ্র গুহ ও জুলহাস এবং কনস্টেবল এসএম মাসুদ রানা।

আকসাদুদজামান যা বললেন : পুলিশের একজন এসআই হয়ে এত টাকা কোথা থেকে দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে আকসাদুদজামান যুগান্তরের কাছে দাবি করে বলেন, ‘ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে ৩৩ লাখ টাকা এসে বাসায় রাখি। ডিবি যখন আমাকে আটক করে তখন জীবন বাঁচানোর জন্য ওই টাকা ডিবিকে দিয়ে দিই। তারপরও যখন ডিবি আমাকে ছাড়ছিল না, তখন আমার স্ত্রী আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে ১৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ডিবির হাতে তুলে দেয়। আমি টাকা ফেরতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’

এডিসি কুরাইশির বক্তব্য : ডিবির এডিসি কায়সার রিজভী কুরাইশি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিমানবন্দর থানার যে মামলায় আকসাদুদজামানসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা পেশাদর ডাকাত চক্রের সদস্য। টাকা উদ্ধার সংক্রান্ত বিষয়ে পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল। এ কারণে কিছু সমস্যা হয়েছে। মামলাটিতে চার লাখ ৭৮ হাজার টাকা লুণ্ঠনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা। তাই অফিশিয়ালি ওই মামলায় এত টাকা উদ্ধার দেখানোর সুযোগ ছিল না। তবে টাকা উদ্ধারের পর সেটা মামলার বাদীকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে বাদী সেই টাকা ডিবিকে দান করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাম্পে বাদীর স্বাক্ষর আছে।’ একই গাড়ি দুদফায় জব্দ দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওটা সরকারি গাড়ি ছিল। ওটি যখন ইচ্ছা তখন জব্দ দেখানোর সুযোগ ছিল। তাই প্রথম দফায় ছেড়ে দেওয়া হয়।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম