মহান ভাষার মাস
একুশের শপথ এটাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু করা

মাহবুব হাসান
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা ধারণ করি অমর একুশের চেতনা, যা আমাদের স্বাধিকারের মূল শেকড়। আমাদের আত্মপরিচয় ও উন্মেষের রাজপথ। আমরা প্রতিবাদ করতে শিখেছি বাহান্নর একুশ থেকে। আমরা রক্ত দিয়ে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠা করেছি এই বাংলাদেশে।
আমরা মুক্তিযুদ্ধে গেছি প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের জোয়ার তুলে, শত্রুহননে, বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে এবং আমরা বিজয় অর্জন করেছি। আকাশে উড্ডীন করেছি আমাদের লালসবুজের পতাকা। ওই অর্জন আমাদের বীরত্বের, গর্বের ও গৌরবের। ওই পতাকাই আমাদের দেশপ্রেম আর জাতির রাজনৈতিক চিহ্ন।
এই কথাগুলো আবেগের ছাঁচে লেখা বলে মনে হবে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে আবেগের কথা নয় এ উচ্চারণ। এ উচ্চারণ আমাদের স্বাধীনতার বর্ণিল ইতিহাস। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে, একজন দেশপ্রেমিক সচেতন সুযোগপ্রাপ্ত শিক্ষিত মানুষ হিসাবে এই সত্য লালন করি।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, লাল সূর্যের মতোই উদিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি চত্বরে বইমেলা। মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা এবং তার লোকজন ১৯৭২ সালে একটি সাদা চাদর বিছিয়ে তার ওপর বই মেলে দিয়ে শুরু করেছিলেন একক বই মেলার। সেই সূচনা। সেই মেলা একুশের বইমেলা নাম ধারণ না করলেও সেটাই ছিল একুশে বইমেলার শেকড়।
চিত্তরঞ্জন সাহা রচিত পথ ধরে একে একে আসতে থাকে অন্য প্রকাশকরা। আশির দশকে প্রকাশকরা মিলিত হয়ে বইমেলা আয়োজন করে বাংলা একাডেমি চত্বরে। পরে একাডেমি ওই মেলা আত্তীকরণ করে নিজেদের নামে চালু করে। সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক ও বাংলা একাডেমি যৌথভাবে এর আয়োজক। কিন্তু সবাই একে বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা নামেই চেনে, জানে ও মনে করে।
বাংলা একাডেমি তার মূল কাজের পাশে মেলা আয়োজনকেও তাদের একটি প্রধান কাজ বলে মনে করে। যদিও একাডেমি বুক প্রমোশন ও মার্কেটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল কাজ করেনি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র নামের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের প্রধান দায়িত্বই বুক প্রমোশন করা। কিন্তু তাদের সে রকম কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ে না।
সৃষ্টিশীল সাহিত্য একটি জাতির মনন ও মেধা বিকাশের প্রধান প্রবাহ, যাকে আমরা নদীর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। প্রত্যেক নাগরিকের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সাহিত্য পাঠ জরুরি-এটা আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলোর চৈতন্যে গুরুত্ব পায়নি।
একবার একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করেছিলাম যে, তিনি জাতির মনন গঠনের এই সেক্টর তথা প্রকাশনাকে শিল্প খাত হিসাবে মর্যাদা দেবেন কি না? শিল্প খাত হিসাবে ঘোষণা দেবেন কি না? তিনি তাৎক্ষণিক উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, হ্যাঁ, তিনি এ কাজটি করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের এই যে, আমাদের নেতানেত্রীরা স্বীকার করেন সবকিছু, কিন্তু কাজটি করেন না। তারা ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তাতে জিতে তারা প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে যান। ঔপনিবেশিক মানসিকতার এই প্রশাসন পরিবর্তনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র বাংলাভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির প্রবাহ কায়েমের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কাজটি করতে হবে। এটাই বর্তমানের, একুশ শতকের প্রধান কাজ।
অমর একুশের শপথ এটাই যে, সর্বস্তরে বাংলা চালু করা। জনগণের মুখের ভাষাকে কায়েম করা ছাড়া প্রকৃত ও প্রকৃষ্ট স্বাধীনতা অর্জন ও ভোগ করা সম্ভব নয়। একুশ শতকে এসেও আমাদের আজ এ-কথা বলতে হচ্ছে। কারণ, এই ২০২৩ সালে এসে দেখছি বাংলা নয় ইংরেজি চর্চার ব্যবসা রমরমা চলছে। এ-জন্যই কি সালাম-রফিক-জব্বার বুকের রক্ত দিয়ে ভাষাকে রক্ষা করে রাষ্ট্রীয় স্তরে নিয়ে এসেছিল? আমাদের যা কিছু অর্জন তার প্রাণবীজ একুশের শহিদদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের আত্মবলিদান। এখন প্রয়োজন তারুণ্যের অদম্য সাহসে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষার আপসহীন চেতনা ও সংগ্রাম।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ