Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

আর্থিক খাতে দুর্নীতি রোধে শক্ত পদক্ষেপ জরুরি

Icon

মনির হোসেন

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আর্থিক খাতে দুর্নীতি রোধে শক্ত পদক্ষেপ জরুরি

দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের সিংহভাগই প্রভাবশালী। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিকভাবে তারা ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতাকে এরা সম্পদ বিকাশের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। কোথাও কোথাও তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। ফলে দুর্নীতি বাড়ছে।

সর্বশেষ দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি আরও এক ধাপ বেড়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। গত বছর যা ছিল ১৩তম।

তবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, টিআই’র এই রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জবাবে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ধরনের বক্তব্য অযৌক্তিক ও অমূলক। কারণ সারা বিশ্ব থেকেই একযোগে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

দুর্নীতির ধারণা সূচক নিয়ে মঙ্গলবার রিপোর্ট প্রকাশ করে জার্মানভিত্তিক সংস্থা টিআই। ওই রিপোর্টে বলা হয় দুর্নীতির সূচকে বিশ্বে ১ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২২ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। যা আগের বছর ছিল ১৩তম। এছাড়াও দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরেও পিছিয়েছে বাংলাদেশ।

১০০ নম্বরের মধ্যে এবার বাংলাদেশ ২৫ নম্বর পেয়েছে। গত বছর যা ছিল ২৬। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। বাংলাদেশের এই অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের আগে।

অর্থাৎ আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে বাংলাদেশের চেয়ে কম দুর্নীতি হয়। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন জরুরি সেবায় যে দুর্নীতি হয়েছে, এই সূচকে তার প্রতিফলন রয়েছে।

জানতে চাইলে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারের নীতি হলো দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। এতে দুর্নীতি রোধ কঠিন। তিনি বলেন, শুধু দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যাচ্ছে তা নয়, বরং তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অপরাধ করেও তারা শাস্তি পাচ্ছে না।

এভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হয়। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা) বা জেহাদ ঘোষণা করা হলো, কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। এতে অন্যায় আরও বাড়ে। ড. বদিউল আলমের মতে, আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। এরপর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, টিআই’র রিপোর্ট সুনির্দিষ্ট কোনো খাতের ওপর নয়, সামগ্রিকভাবে সরকারি খাতের ওপর। তবে এর সঙ্গে শুধু সরকারি কর্মকর্তা বা আমলারা জড়িত নয়। এখানে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্তরা জড়িত।

তিনি বলেন, আলোচ্য সময়ে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেই। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বরং এক্ষেত্রে দায়ীদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতাকে সম্পদ বিকাশের হাতিয়ার বানানো হয়েছে।

পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তার মতে, খাতভিত্তিক হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত খাত হলো ব্যাংক ও আর্থিক খাত। খেলাপিঋণ, জাল-জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে পুরো খাতের খারাপ অবস্থা। এর সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তার মতে, এই ধরনের দুর্নীতি রোধে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। তার মতে, দুর্নীতি রোধে সামগ্রিকভাবে দুটি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত চুনোপুঁটিদের ধরে টানাহ্যাঁচড়া নয়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের একটি বার্তা দিতে হবে। উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ ক্ষমতাবানদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এক্ষেত্রে দুদককে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি বৃদ্ধির তিনটি কারণ। প্রথমত রাষ্ট্র দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ব্যাংক লুট করল কিন্তু তার কিছু হয়নি।

দ্বিতীয়ত, সরকার দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করে-যেমন, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তাদের সেই টাকা দেশে ফেরত আনলে কর ছাড় দেওয়া হবে, এমন ঘোষণাও এসেছে। তৃতীয়ত সমাজ দুর্নীতি মেনে নয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আগে কেউ দুর্নীতি করলে মানুষকে তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু বর্তমানে তাদের মানসম্মান সবচেয়ে বেশি। তারাই মন্ত্রী-এমপি হয়। এ অবস্থায় দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়।

এদিকে টিআইবির বক্তব্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন ‘অনেকের মতেই নির্বাচনের বছরে বিশ্ববেনিয়াদের প্রেসক্রিপশনে দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশকে এক ধাপ নামানো হয়েছে। বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানের আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, আগামী বছর নির্বাচন। এর আগে আর কোনো প্রতিবেদন হবে না। এ কারণে সংস্থাটি এ কাজ করেছে। ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সাম্প্রতিক টিআই’র কার্যক্রম অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে যখন মিথ্যা অভিযোগ উপস্থাপন করা হলো, তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল আগ বাড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে দুর্নীতি হয়েছে। পরে দেখা গেল, দুর্নীতি তো হয়ইনি বরং কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংক হেরে গেছে।

বিশ্বব্যাংক আবার এসে প্রস্তাব করেছিল, তারা অর্থায়ন করতে চায়। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা নেননি। এই ঘটনার জন্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ক্ষমা চায়নি। এভাবে করোনার টিকাসহ নানা বিষয় নিয়ে তাদের বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়েছে।

এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি একটি গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন। এর উদ্দেশ্য হলো বৈশ্বিকভাবে এবং বাংলাদেশের ভেতরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে সহায়তা করা। পাশাপাশি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারকে সহায়তা করা। এর সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে মিলিয়ে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। তিনি বলেন, যদি কেউ এই প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে, তবে আমরা বলব উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হলো সরকারের হাতকে শক্তিশালী করা।

তিনি বলেন, প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের একটি বিশেষ মহল থেকে এর সঙ্গে রাজনীতি ও নির্বাচনকে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এটি একেবারেই অমূলক। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে কথা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, টিআইবি বলেছিল পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তুু সরকারের এই বক্তব্য সঠিক নয়।

তিনি আরও বলেন, আর পদ্মা সেতু হলো আমাদের জাতীয় ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল বিশ্বব্যাংক। সেক্ষেত্রে আমরা বলেছি আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য তদন্ত চাই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম