স্বপ্ন, সাহসের মুক্ত ডানায় উড্ডীন
সাইফুল আলম
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একুশ শতকের সূচনালগ্নে দৈনিক যুগান্তরের যাত্রা শুরু। আজ দ্বিতীয় যুগে পদার্পণের মধ্য দিয়ে অব্যাহত রয়েছে আমাদের সেই পথচলা।
যুগোৎসবের এ আয়োজনে আমরা শোকাহত চিত্তে যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা, যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা, দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রয়াত নুরুল ইসলাম সাহেবের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, কর্মবীর স্বপ্নদর্শী এ মানুষটি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, একদিন তিনি থাকবেন না, কিন্তু তার কাজ থাকবে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য তার অবদান দেশের মানুষ মনে রাখবে। তার বিশ্বাস সত্য ছিল তাতে সন্দেহ নেই।
তার উত্তরসূরিরা তার সেই স্বপ্ন, বিশ্বাস ও কর্মস্পৃহাকে নিজেদের জীবনে ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আজ এই বিশেষ দিনে তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত নেই, কিন্তু তার উত্তরসূরিদের কর্মস্পৃহায় দুর্নিবার অনুপ্রেরণা হয়ে তিনি উপস্থিত আছেন আমাদের প্রতিটি কাজে।
দুই যুগ দীর্ঘ সময়। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর অজস্র মানুষের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রামের সূচনা করেন। তারই ধারাবাহিক পরিণতি স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশভূমি এই বাংলাদেশ। তাঁর স্বপ্নের সেই স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের যে আকাঙ্ক্ষা তা বারবার ব্যাহত হয়েছে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ঘাতকেরা জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে হত্যা করার প্রয়াস পেয়েছে, তাকে শারীরিকভাবে হত্যা করে। কিন্তু যুগে যুগে কালে কালে সত্য এটাই যে, স্বপ্নদর্শীর মৃত্যু নেই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মাঝে তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনিঃশেষ প্রেরণা হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।
গণ-আকাঙ্ক্ষার মর্যাদা, গণ-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের ঐতিহাসিক কালপর্বে ২০০০ সালে, একুশ শতকের সূচনায় যুগান্তরের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠিত অনেক পত্রিকার ভিড়ে আরেকটি পত্রিকা শুধু পুঁজির বিনিয়োগে যাত্রা শুরু করেনি।
আমরা যুগান্তর প্রকাশনার আগে সারা দেশে বিভিন্ন সেক্টরের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। জানতে চেয়েছি কেমন পত্রিকা তারা চান? একটি নতুন পত্রিকা তাদের কোন কোন আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করলে তাদের মুখপাত্র বলে মনে করবেন? আমরা তাদের কথা শুনেছি, তাদের স্বপ্নকে রূপায়িত করার জন্য যুগান্তরের পৃষ্ঠাগুলোকে তাদের আকাঙ্ক্ষার ঠিকানারূপে তৈরির চেষ্টা করেছি। সেটাই ছিল যুগান্তরের সাফল্য! আমাদের স্লোগান ‘পাঠকের অন্তরজুড়ে যুগান্তর’।
এ শব্দগুলো তাদের অন্তর থেকেই উঠে এসেছে। অর্থাৎ, আমরা আর দশটা পত্রিকার মতো উপর থেকে চাপিয়ে দেইনি নতুন আরেকটি কাগজ। আমরা পাঠকের অন্তরের কথাগুলোকে বাক্সময় করার প্রয়াস পেয়েছি। যুগান্তরের পুঁজির সঙ্গে আরও যে পুঁজি যুক্ত করতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম তা হচ্ছে-এ দেশের মানুষের নির্বাক অন্তরের সবাক উপস্থাপনা।
দুই যুগের দীর্ঘ যাত্রায় আমরা অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছি। আমাদের দায়বদ্ধতা দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি। আমাদের দায়বদ্ধতা সত্যের প্রতি।
৩.
সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আমাদের দুই যুগের সুদীর্ঘ যাত্রার অভিজ্ঞতায় আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এই-সংবাদপত্র হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতির ‘ব্রিদিং স্পেস’, তথা শ্বাস নেওয়ার মুক্তাঙ্গন।
ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র-এসবের নানা স্তরে, নানা মাত্রায় আমরা বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি এবং ভুল সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ প্রায়শই গ্রহণ করি; সংবাদপত্র সেটা শনাক্ত করে শুধরে নিতে আমাদের সচেতন করে। যাকে বলে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স-‘ওয়াচ ডগ’ হিসাবে সংবাদপত্র সেই ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়ক হয়। খাদের পাড় থেকে আমাদের ফিরিয়ে আনে।
এ দেশেরই সন্তান নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন একটি প্রসিদ্ধ উক্তি করেছেন-‘যে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ একজন সংবাদকর্মী হিসাবে আমার উপলব্ধি শুধু ‘দুর্ভিক্ষ’ নয়, যে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে, সে দেশে আরও অনেক অশুভ থাকে না; যেমন-সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুঃশাসন প্রভৃতি। আমরা তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সব সময় সক্রিয় ও সোচ্চার থেকেছি। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। আমরা সব সময় দায়িত্বশীলতার পক্ষে অবস্থান করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই, কোনো বিকল্প নেই দায়িত্বশীলতারও।
৪.
বর্তমান বিশ্ব এবং আমাদের দেশ একটা ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য বলে অভিহিত করছেন; এমনি কঠিন দুর্যোগ ও দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবী তার আহ্নিক ও বার্ষিক গতি অতিক্রম করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্র কিছু দিন আগে সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল করোনাভাইরাস। সেই অপূরণীয় ক্ষতি পূরণের সময় পায়নি পৃথিবীবাসী-শুরু হয়ে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন তথা ইউরোপের লড়াই। যার ফলে পৃথিবীব্যাপী সূচনা ঘটেছে মহামন্দার। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনযাপন। সর্বত্র চলছে টিকে থাকার লড়াই।
পৃথিবীব্যাপী খাদ্যপণ্যসহ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সব উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারি ও যুদ্ধ আমাদের নতুন মাত্রার দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রও এ বাস্তবতার বাইরে নয়। এ সংকটের বাইরে নয় অন্য গণমাধ্যমও। মাত্র কদিন আগে যুক্তরাজ্য সরকার বিবিসি রেডিওর বাংলা সার্ভিসের সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী প্রিন্ট মিডিয়া এক সংকটজনক বাস্তবতার মুখোমুখি।
দেশে-বিদেশে অনেক মুদ্রিত সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে কর্মী কমিয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়েছে। এ কঠিন বাস্তবতার ভেতরেও আমরা যুগান্তরের টিকে থাকার লড়াইয়ে পিছু হটিনি।
আমাদের এ সাহস ও সংগ্রামের অনিঃশেষ অনুপ্রেরণা যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা নুরুল ইসলাম এবং তার পরিবার-‘করোনা দুর্যোগে’র সময়ে যারা যমুনা গ্রুপের সব কর্মীকে আপন পরিবারের মতো আগলে রেখেছেন। পরবর্তীকালে প্রেস কাউন্সিল এর স্বীকৃতি প্রদান করেছে যুগান্তরকে ‘করোনাকালীন দুর্যোগে প্রাতিষ্ঠানিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা’র জন্য পুরস্কৃত করে।
আমরা মনে করি, এ স্বীকৃতি, সম্মান যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টারও। তাই এ সম্মান আমরা উৎসর্গ করেছি আমাদের প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের অনুসরণীয় স্মৃতির উদ্দেশে। যিনি আমাদের সব সময় এ শিক্ষা দিয়েছেন-বিপদে যেন সাহস না হারাই।
৫.
বাংলাদেশেও গণমাধ্যম তথা প্রিন্ট মিডিয়া কঠিন সময় পার করছে। এক দিকে বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন কমেছে, আরেক দিকে বেড়েছে নিউজ প্রিন্টসহ সব মুদ্রণ উপকরণের মূল্য। করপোরেট ট্যাক্সের হারও বেশি। এসব বৈরী প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের।
মুক্তচিন্তা আর গণতন্ত্রের লড়াইয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে বলে আমরা মনে করি।
বিশ্বব্যাপী এ মহামন্দার সময়ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, যমুনা রেলসেতু প্রভৃতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকাকে করছে গতিশীল। এসব ইতিবাচক উন্নয়নের তাৎপর্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত করা প্রয়োজন।
৬.
পৃথিবী এখন আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে। এক গোলার্ধে যখন মানুষ ঘুমোচ্ছে তখন অন্য গোলার্ধে সম্পন্ন হচ্ছে তাদের কাজ। এক গোলার্ধের বন্যা বা ঝড়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছে আরেক গোলার্ধের মানুষ। একইভাবে তাদের ভূমি তুষারে ঢেকে গেলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে অন্য গোলার্ধের মানুষের।
উনিশ শতকে আমাদের কবি যে লিখেছিলেন-
“আমরা দু’জন একটি গাঁয়ে থাকি।
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক।”
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : এক গাঁয়ে; ক্ষণিকা]
কবির সে কথা আজ সত্য হয়ে উঠেছে। এটাই আজকের বাস্তবতা বলেই আমাদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল শুধু দেশের চৌহদ্দিতে, তা আজ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। প্রযুক্তি আমাদের সেখানে পৌঁছতে সহায়তা করেছে। আজ বিশ্বের ১৫৪টি দেশে যুগান্তর পড়তে পারে পাঠক। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাঙালি পাঠকের কাছে দেশের ‘আয়না’ আজ যুগান্তর। তাই অনলাইনে আমরা পাঠকের প্রীতিধন্য ও জনপ্রিয় দৈনিক।
এই বৈরী বৈশ্বিক বাস্তবতায়-বিশ্বমন্দা, বিশ্ব ‘সংকটে’ও আমাদের ‘সম্ভাবনা’র পথ অনুসন্ধান করতে হবে সব মানবিক প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠতে। এ সত্যটি শুধু দেশের নেতৃত্ব নয়, দেশে দেশে আরও যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের চৈতন্যে প্রতিফলিত হতে হবে।
৭.
সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সম্পর্কে দুজন বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিকের দুটি উদ্ধৃতি আমি স্মরণ করি। প্রথমটি Arthur Miller-এর। তার মতে ‘A good newspaper, I suppose, is a nation talking to itself.’
হ্যাঁ, একটি ভালো সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে একটি জাতি কথা বলে। আমরা এমনটাই উপলব্ধি করি। যুগান্তর তার পাঠকের কাছে, দেশের কাছে, মানুষের কাছে এমনই ওতপ্রোতভাবে দায়বদ্ধ।
দায়বদ্ধতার এ অঙ্গীকারটিতে আমরা অবিচল ছিলাম, অবিচল আছি-কারণ আমরা জানি এটাই আমাদের শক্তি, অনুপ্রেরণা।
আরেকজন বিখ্যাত সম্পাদক ঐবহৎু জ. খঁপব সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে যে কথাটি বলেছেন, সেটিও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘I become a journalist to come as close as possible to the heart of the world.’
এটাই একুশ শতকের সাংবাদিকের গন্তব্য, একজন সাংবাদিককে আজ পৃথিবীর হৃদয়ের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হয় নিরন্তর-এ উপলব্ধি এক গভীরতর কাব্যিক ও দার্শনিক উপলব্ধি। আমরা চাই কিংবা না চাই-সময় আমাদের এ বাস্তবতার মাটিতে নিয়ে এসেছে।
সাইফুল আলম : সম্পাদক, যুগান্তর,
সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব
saifullam.editorjugantor@gmail.com