তিন দিন পর শুরু অমর একুশে গ্রন্থমেলা
জনপ্রিয় লেখকের বই মুদ্রণে মনোযোগ
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অমর একুশে বইমেলার প্রস্তুতি জোরেসোরে এগিয়ে চলছে। আর মাত্র তিনদিন পর শুরু হবে বাঙালির এই প্রাণের মেলা। স্টল বরাদ্দ পাওয়ার পর প্রকাশকরা তা নির্মাণ আর সাজসজ্জায় নিয়োজিত হয়েছেন।
শুক্রবার পর্যন্ত বেশিরভাগ প্রকাশনীর স্টলের কাজ অর্ধেকের মতো শেষ হয়েছে। তবে এবার মেলা শুরুর আগেই স্টল নির্মাণ আর গ্রন্থ মুদ্রণে হতাশাজনক চিত্র দেখা গেছে। বাজারে কাগজ সংকট আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেকেই ভালো বেচাবিক্রির ব্যাপারে সন্দিহান। এতে বই মুদ্রণ ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
পাশাপাশি প্রকাশকরা নবীন লেখকদের পরিবর্তে জনপ্রিয় লেখকের বই মুদ্রণে মনোযোগ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
মেলায় এবার ৪২৬টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে ৭২৫টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে লটারির মাধ্যমে। এরমধ্যে প্যাভিলিয়ন ৩৪টি আর স্টল ৬৯১টি।
গত ২৩ জানুয়ারি মেলার স্টল-প্যাভিলিয়নের মূল কাজ শুরু হয়েছে। তবে ২৯ জানুয়ারি রাত ১২টার মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার সময় দেওয়া আছে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে।
মেলার সদস্য সচিব ডা. মুজাহিদুল ইসলাম জানান, এরপর কিছু কাজ বাকি থাকলে হয়তো ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিতে পারি। কিন্তু ৩১ তারিখে আর কোনো বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে না।
মেলার নিয়ম-কানুন নিয়ে কমিটি শুরু থেকে কোনো ধরনের নমনীয়তা গ্রহণ করবে না। সাধারণত মেলা এলে লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে আনন্দ-উৎসব বিরাজ করে। কিন্তু এবারে এর ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কাগজ, বই ছাপানোর প্লেট, কালিসহ সব ধরনের উপকরণের দাম এবার প্রায় দ্বিগুণ। এ কারণে কোনো কোনো বইয়ের দাম দ্বিগুণ হবে। বিশেষ করে কবিতাসহ যেসব বই ১০০ জিএসএম কাগজে ছাপানো হবে সেসব বইয়ের দাম দ্বিগুণ হবে।
আর যেসব বই ৮০ জিএসএম কাগজে ছাপানো হবে সেগুলোর বইয়ের দাম ৭০-৮০ শতাংশ বাড়তে হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এত দামে বই বিক্রি হবে কি না। এ কারণে লেখক নির্বিশেষে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে প্রকাশকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, দাম বেশি হওয়ায় এবার বই বিক্রি কমে যেতে পারে। এ কারণে বেশিরভাগ প্রকাশক বইয়ের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আর যে সংখ্যক বই প্রকাশ করা হবে, তারমধ্যে নবীন আর উঠতি লেখকদের বই বাদ যাচ্ছে। কেবল বাজার চাহিদা আছে এমন জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশের চিন্তায় আছেন প্রকাশকরা।
এরফলে যেহেতু প্রবন্ধ, গবেষণার মতো সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক কম তাই এ ধরনের বইয়ের প্রকাশনাও কমে যেতে পারে। উল্লিখিত কথার সমর্থন মেলে অনিন্দ্য প্রকাশের স্বত্বাধিকারী আফজাল হোসেনের বক্তব্যে।
তিনি শুক্রবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘বইমেলায় এবার সবচেয়ে বড় ধাক্কা হবে গ্রন্থ প্রকাশনায়। আমি সাধারণত ১৩০টি গ্রন্থ প্রকাশ করি। কিন্তু এবার মাত্র ৪০ বই বাছাই করেছি।
এবার ঝুঁকিটা নিচ্ছি না কয়েকটি কারণে। প্রথমতো বইয়ের দাম ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ বাড়ানো দরকার। কিন্তু এত দাম বাড়ালে বিক্রি হবে না। লাভ কম করার লক্ষ্যে ৩৩ থেকে ৪০ শতাংশ দাম বাড়াবো।
এরপরও বইয়ের পৃষ্ঠা আর দামের পার্থক্য নিয়ে পাঠকের সঙ্গে নিশ্চিত ঝগড়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যেসব বই এবার বাদ দিচ্ছি তার মধ্যে নবীন আর উঠতি লেখকের বই রেখেছি।
আগে ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাদের বই প্রকাশ করতাম। অন্য বিক্রি নিয়ে কম চলা বইয়ের ঘাটতি মেটানো হতো। কিন্তু এবার সেই সুযোগ নেই।
অবসর প্রকাশনা সংস্থার ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা যুগান্তরকে জানান, তাদের বেশিরভাগ বই একাডেমিক এবং প্রবন্ধ-গবেষণার মতো সিরিয়াস ধর্মী লেখা। তিনি বলেন, এসব বইয়ের পাঠক কম।
বিনিয়োগ তুলতে অনেক দিন লেগে যায়। কিন্তু এবার এই দুর্মূল্যের বাজারে টাকা অলস ফেলে রাখার সুযোগ কম। তাই কোম্পানি এবার জনপ্রিয় বই প্রকাশের নীতি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি ও পুঁথিনিলয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল বলেন, জ্ঞানভিত্তিক ও সৃজনশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে সরকারকে এই খাতে ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিতে হবে।
এটা সরকার বিভিন্ন উপায়ে করতে পারে। বর্তমানে সারা দেশে মাত্র ৭২টি পাঠাগার আছে। এখন একটি বইমেলায় বিক্রি না হলে সরকার কিনলে ৭২ কপি বিক্রি হবে। কিন্তু সরকার প্রতিবছর বই কেনে না।
আবার পাবলিক লাইব্রেরিতে সবচেয়ে ভালো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য বই কেনা বাবদ ৬০ হাজার টাকার কোটা আছে। এছাড়া ৪০ হাজার ২০ হাজার ও ১০ হাজার টাকার বই বিক্রি করতে পারে এক একটি প্রতিষ্ঠান।
এভাবে বিক্রি হলে একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বই প্রকাশ করবে। অন্যদিকে পাবলিক লাইব্রেরির বই কেনা খাতে আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। দেশে প্রায় ৬০০ প্রকাশক আছেন।
তাহলে একটি প্রতিষ্ঠান কত টাকার বই বিক্রি করতে পারে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও বই কেনে না তারা। সবমিলে এবারের বইমেলা তেমন উৎসব নিয়ে আসছে না।
জানা গেছে, গতবছর ৮০ জিএসএম কাগজ প্রতি রিম ১৬শ’ টাকা ছিল। এবার তা সর্বোচ্চ ৩৫শ টাকা। আর ১০০ জিএসএম কাগজের প্রতি রিমের দাম দ্বিগুণ হয়ে এবার সাড়ে ৪ হাজার টাকা হয়েছে।
বইয়ের কাভার আর্ট কার্ডেও দাম ডলারের সমান্তরালে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু বই ছাপানোর প্লেটের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, দাম বাড়ানোর পরও কাগজের মানও এবার ভালো নয়।
ভার্জিন পাল্পের সঙ্গে ‘ছাট কাগজ’ (অন্য ছাপানো বইয়ের চার পাশ কেটে যে কাগজ বের হয়) মিলিয়ে পাল্পে কাগজ তৈরি করেছে মিল মালিকরা। ফলে কাগজে ফিনিশিং নেই, রঙও নষ্ট হয়েছে। এটা নিয়ে প্রকাশকরা লেখকের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডার শঙ্কাও করছেন।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সার্বিক বাস্তবতায় মনে হচ্ছে এবার মেলায় বই কম আসবে। বিপরীত দিকে বইয়ের দাম বাড়বে। আর তেমনটি হলে বই বিক্রি কম হবে। যদিও মেলায় আড্ডার কমতি হয়তো থাকবে না।
এই লেখক বলেন, অমর একুশে বইমেলা কেবল বই বিক্রির মেলা নয়। এরসঙ্গে নতুন লেখক ও পাঠক সৃষ্টি এককথায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃষ্টির সম্পর্ক আছে। তাই বাজারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ভর্তুকির ব্যবস্থা করে প্রণোদনা দিতে পারতো।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে যে, তারা যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে তাদেরকে সংস্কৃতিকে জাগাতে হবে। নইলে আ.লীগের মতো দল ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আসতেও পারবে না। কেননা, ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে সংস্কৃতিমনাদের সমর্থন নেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে বইমেলা একটা উপায় হতে পারে।