বায়ুদূষণে বিশ্বে টানা ৫ দিন শীর্ষে ঢাকা
রাজধানীতে দূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি * বায়ুদূষণে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, মারা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১ লাখ মানুষ * ঢাকার বায়ুদূষণ রোধের বিষয়টি বৃষ্টিনির্ভর হয়ে পড়েছে-ক্যাপস পরিচালক
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভয়ংকর বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে ঢাকা শহর। শনিবার থেকে বুধবার টানা পাঁচ দিন বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় স্থান করে নেয় বাংলাদেশের রাজধানী।
সাধারণত দিনের শুরুতে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। সূর্য যতই গোধূলির দিকে যেতে থাকে, দূষণের মাত্রাও ততই কমে যায়।
কিন্তু বুধবার সকাল থেকে রাত অবধি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দূষণের শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
এমনকি রাতে যেখানে দূষণ কমে আসার কথা, সেখানে উলটো বেড়েছে। সার্বিকভাবে ঢাকার বাতাসে দূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়েও পাঁচগুণ বেশি।
বিশ্বে বাতাসের দূষণ নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করে, সেগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অন্যতম। সংস্থাটির সকাল ১০টা ১৮ মিনিটের রিয়েল টাইম (তাৎক্ষণিক) দূষণ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৭৬ মাইক্রোগ্রাম দূষণ নিয়ে একনম্বরে অবস্থান করে ঢাকা। এরপর দুপুর ১টা, বিকাল ৪টা ও ৫টা এবং সন্ধ্যা ৬টা ও রাত ৮টায় ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছিল। দুপুর ১টায় বাতাসে দুষিত ধূলিকণার পরিমাণ ছিল ২৫৩ মাইক্রোগ্রাম, বিকাল ৪টায় ২৪৩ এবং ৫টায় ছিল ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু সন্ধ্যা ৬টায় তা বেড়ে আবার ২৪০ মাইক্রোগ্রাম হয়েছে। আর রাত ৮টায় তা আরও বেড়ে ৩২৪ হয়েছে, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি। সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম ধূলিকণা ও গ্যাসীয় পদার্থকে সহনীয় মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
ঢাকার বাতাস এত দূষিত কেন-এই প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের বাষুদূষণ নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের কাছে।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার বাতাসে বস্তুকণা ২.৫ নামের অতি সূক্ষ্ম পদার্থ স্বাভাবিকের চেয়েও ৫০০ গুণ বেশি ভেসে বেড়াচ্ছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালের ধারাবাহিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক বছরে ওই দূষণ বেড়েছিল ১০ শতাংশের বেশি। এই অবনমন দিনদিন বাড়ছেই। তিনি আরও বলেন, বায়ুদূষণে মূলত বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নকাজ ভূমিকা রাখছে।
এর মধ্যে নির্মাণ খাত ও ইটভাটা অন্যতম। এছাড়া কলকারখানা থেকে নিঃসারিত বিভিন্ন ধরনের কার্বন, শুষ্ক মৌসুমের কারণে সৃষ্ট ধুলাবালি, ময়লা-আবর্জনাসহ বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া ইত্যাদি অন্যতম। তিনি বলেন, ঢাকার বাতাসের মান ভালো রাখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। যদিও তাদের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। এজন্য বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় ও সহযোগিতা দরকার।
কিন্তু এ কাজটি পরিবেশ অধিদপ্তরকেই করতে হবে, সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আসলে বর্তমানে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধের বিষয়টি বৃষ্টিনির্ভর হয়ে পড়েছে।
উল্লিখিত একিউআই-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার সারা দিনই ঢাকা দূষণে শীর্ষস্থান ধরে রাখলেও একই সময়ে দ্বিতীয় থেকে পরবর্তী স্থানগুলোয় অন্য শহরের ওঠানামা দেখা গেছে। সকাল ১০টার দিকে ১৯৭ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল পাকিস্তানের করাচি। তৃতীয় অবস্থানে ছিল উজবেকিস্তানের তাসখন্দ (স্কোর ১৯৪)। এছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে ছিল ভারতের কলকাতা এবং নেপালের কাঠমান্ডু। দুপুর ১টায় দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম স্থানের শহরগুলো হচ্ছে-পাকিস্তানের লাহোর, ইরাকের বাগদাদ, ভারতের দিল্লি ও কলকাতা। বিকাল ৪টার দিকে লাহোর, তাসখন্দ, কলকাতা ও দিল্লি উঠে আসে। বাগদাদ চলে যায় ষষ্ঠ স্থানে। বিকাল ৫টায় লাহোর, দিল্লি, কলকাতা ও মুম্বাই ছিল দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম স্থানে। আর সন্ধ্যা ৬টায় দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম স্থানে থাকা শহরগুলো হলো-লাহোর, বাগদাদ, তাসখন্দ ও কলকাতা। মুম্বাই এ সময়ে ষষ্ঠ স্থানে চলে গেলেও শীর্ষ ১০টি দূষণের শহরের মধ্যে দিল্লি ছিল না।
বায়ুবিজ্ঞানীদের মতে, বায়ু পরিমাপের সূচকে প্রতি ঘনমিটারে ধূলিকণাসহ অন্যান্য গ্যাসীয় দূষণ ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত অনুমোদিত। অর্থাৎ, এই পরিমাণ দূষণ থাকলে সেই বায়ু শরীরের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত স্কোর থাকলে তা ভালো বায়ুমান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এভাবে ৫১-১০০ স্কোর হলে তা মোটামুটি, ১০১-১৫০ পর্যন্ত সতর্কতামূলক, ২০১-৩০০-এর মধ্যে থাকলে সেই মাত্রাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর ৩০১-এর বেশি স্কোরকে বলা হয় বিপজ্জনক বায়ু। এই হিসাবে বুধবার সারা দিন চরম মাত্রার অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে ছিলেন ঢাকার নাগরিকরা।
গত বছর দেশের ৬৪ জেলার বায়ুদূষণের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ক্যাপস। সংস্থাটি বলছে, বৈশ্বিক তালিকায় সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা হলেও ৬৪ জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে গাজীপুরে। সেখানকার বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম দূষণ পাওয়া যায়। আর ২০২১ সালে একই সংস্থা ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানের বায়ুদূষণ সমীক্ষা প্রকাশ করে। সেটি অনুযায়ী ঢাকার সবচেয়ে বেশি দূষিত তিনটি এলাকা হচ্ছে-এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট ও তেজগাঁও শিল্প এলাকা। এক বছরে দূষণ বেড়েছে ১০.২ শতাংশ। আর একই সময়ে সর্বোচ্চ ২০০ গুণ দূষণ বেড়েছে নিউমার্কেট এলাকায়। দেশের সবচেয়ে কম দূষিত শহর মাদারীপুর, যেখানকার বাতাসে সহনীয় মাত্রারও নিচে বা ৪৯ দশমিক শূন্য ৮ মাইক্রোগ্রাম দূষণ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকার বায়ু এত দূষিত কেন? এর জবাবে ড. মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কালকে শুষ্ক মৌসুম হিসাবে ধরা হয়। এই চার মাসে প্রায় সব সময়ই বাতাস দূষিত থাকে। এর কারণ হচ্ছে, এই সময়ে বাতাসের গড় তাপমাত্রা কমে যায়। তখন ধুলাবালি শুকিয়ে গিয়ে উড়তে থাকে। বায়ুচাপ এই সময়টাতে কমে যাওয়ায় ধুলাবালি বেশি দূরে না গিয়ে স্থলভাগের কাছাকাছি বা বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে উড়তে থাকে। বিপরীত দিকে কলকারখানা, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ময়লা-আবর্জনার বর্জ্য পোড়ানোসহ প্রায় সব উৎস থেকে বায়ু দূষিত হয়। এমনকি এই সময়ে গাছের পাতায় বা ভবনের গায়ে যে ধুলাবালি পড়ে থাকে, তাও উড়তে থাকে বাতাসের চাপ পেলে। বৃষ্টির মৌসুম না আসা পর্যন্ত এই দূষণ অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
এখন প্রশ্ন উঠেছে বায়ু দূষিত থাকলে সমস্যা কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, দূষিত বায়ু থেকে সাধারণত ফুসফুসজনিত রোগ হয়। এর মধ্যে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি অন্যতম। মানসিক চাপ বা উচ্চরক্তচাপকেও অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু গবেষণায় সম্প্রতি ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত কিছু রোগও বায়ুদূষণের কারণে হয়ে থাকে বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাতাসের মাধ্যমেও এই রোগের অণুজীব বা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে বস্তি এলাকায় যেমন এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তেমনই ধানমন্ডির মতো আবাসিক এলাকায়ও এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি সম্প্রতি ঢাকার ১৬ স্থানে ১২৮টি স্যাম্পল নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করে দেখেছে। এভাবে অণুজীব ভেসে বেড়ানোর ফলে অ্যালার্জি, গলায় ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, চোখের রোগসহ প্রতিনিয়ত নানা রোগ ছড়াচ্ছে। বায়ুদূষণে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় তিন বছরে করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ, প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এর ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি মারা যায় বায়ুদূষণে। সুতরাং, সচেতন না হলে মৃত্যুর হার দিনদিন বাড়তেই থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় বায়ুদূষণের বিভিন্ন কারণগুলোর অন্যতম অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। একবার এক রাস্তা একটি সংস্থা কাটে। তারা যেতে না যেতেই আবার আরেক সংস্থা ওই রাস্তা কাটে। ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে গত এক মাসের মধ্যে এভাবে ওয়াসাসহ দুটি সংস্থাকে রাস্তা কাটতে দেখা যায়। অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, এই মুহূর্তে ঢাকায় অন্তত একশ স্থানে একইভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তবে এদিক থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তুলনামূলক ভালো কাজ করছে। আমরা আজ (বুধবার) সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, অন্তত ৩০ কিলোমিটার এলাকায় তারা পানি ছিটিয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এভাবে পানি ছিটিয়ে দূষণ রোধ করা সম্ভব।
বায়ুসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণ নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়। গত বছরের ৩১ মার্চ পয়েন্ট অব অর্ডারে জাতীয় পার্টির সংসদ-সদস্য পীর ফজলুর রহমান বিভিন্ন ধরনের দূষণ নিয়ে আলোচনাকালে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা এখন শব্দদূষণে এক নম্বরে, বায়ুদূষণেও এগিয়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উন্নয়ন কাজে কোনো সমন্বয় নেই। এক সংস্থা রাস্তা তৈরি করে আবার কিছু দিনের মধ্যে অন্য সংস্থা রাস্তা কাটে।’
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট ৯ দফা নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। এর মধ্যে আছে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানা। কিন্তু এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বায়ুদূষণ থেকে মুক্তির উপায় কী-এই প্রশ্নের জবাবে ক্যাপস পরিচালক বলেন, এর সঙ্গে বায়ুদূষণের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান জড়িত। মানুষের মৃত্যু বাদ দিয়ে যদি কেবল আর্থিক ক্ষতি ধরা হয়, সেটা বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আরেক হিসাবে দেখা যায়, বায়ুদূষণে ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। বর্তমানে ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশন কমবেশি পানি ছিটিয়ে থাকে। এতেও খরচ আছে। কিন্তু যদি সরকার ঢাকার ওপর কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করে, তাহলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় এর চেয়েও খরচ কম হবে। সুতরাং, সরকার এই চিন্তা করতে পারে। পাশাপাশি তিনি নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ দ্রুত কার্যকর ও নির্মাণকাজের সময় পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় রেখে স্পষ্ট বিধিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দেন।