Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিশ্ব ইজতেমা

দেশের সমৃদ্ধি ও বিশ্বশান্তি চেয়ে রোনাজারি

আখেরি মোনাজাতে শেষ হলো প্রথম পর্ব * যানবাহন সংকটে ভোগান্তি, হেঁটেই বাড়ি ফেরেন কয়েক লাখ মানুষ * দুই থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায়

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন এবং টঙ্গী পশ্চিম ও পূর্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের সমৃদ্ধি ও বিশ্বশান্তি চেয়ে রোনাজারি

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো দাওয়াতে তাবলিগের সবচেয়ে বড় জমায়েত ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। রোববার সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয় এ মোনাজাত। ২৩ মিনিট ধরে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দুয়ারে রোনাজারি করেন কাকরাইল মসজিদের শূরা সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের। তার সঙ্গে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে আল্লাহর দুয়ারে নিজেকে সঁপে দেন কয়েক লাখ মুসল্লি। এ সময় টঙ্গীর তুরাগ তীরসহ আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় নেমে আসে ভিন্ন আবহ। মোবাইল ফোনে ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের আরও কোটি মানুষ একসঙ্গে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। মোনাজাতে দেশের সমৃদ্ধি, দেশবাসী ও বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদের কল্যাণ ও বিশ্বশান্তি কামনা করা হয়। আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজতের আকুতি জানান মুসল্লিরা।

আরবি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় মোনাজাত করা হয়। রোববার ভোর থেকে দিকনির্দেশনামূলক বয়ানের পর লাখ লাখ মুসল্লির প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। দক্ষিণে খিলক্ষেত, উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা, পূর্বে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ও পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটারের এ বিশাল জনসমুদ্রে মোনাজাতের সময় নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। প্রথম ১০ মিনিটব্যাপী মোনাজাতে মাওলানা জুবায়ের পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। পরে ১৩ মিনিট বাংলা ভাষায় মোনাজাত করেন। অনেকে বিমানবন্দর গোলচত্বর কিংবা উত্তরা থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

বিশ্ব ইজতেমায় শুধু আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ছুটে আসতে থাকেন শনিবার থেকেই। বাস, ট্রাক, মিনিবাস, কারসহ বিভিন্ন পরিবহণে করে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করেন মুসল্লিরা। রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে শীত, কুয়াশা ও নানা ঝক্কিঝামেলা উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখী হন। রোববার সকালেও চারদিক মুসল্লিরা হেঁটেই টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা স্থলে পৌঁছেন। সকাল ৮টার আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। রোববার ভোর থেকেই ফজরের নামাজ ও আখেরি মোনাজাতের জন্য পুরোনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা মেলে শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ।

এদিন আখেরি মোনাজাতের জন্য আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। এমনকি নারীরাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছান। আখেরি মোনাজাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী সিদ্দিকউল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা-১৮ আসনের এমপি হাবিব হাসান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন।

এদিকে ময়দানে লাশের জিম্মাদার মাওলানা মুহাম্মদ শাকের যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ইজতেমার প্রথম পর্বের তিন দিনে ৮ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। জানাজা শেষে তাদের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

যানবাহন সংকটে ভোগান্তি : আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেন। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়কগুলোতে দীর্ঘ জনজট ও যানজট সৃষ্টি হয়। বাস, মিনিট্রাক, ভ্যানগাড়িতে করে ঢাকায় ফিরতে দেখা গেছে মুসল্লিদের। মানুষের ভিড়ে ট্রেনগুলোতে তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না। মোনাজাতের শুরুতে মানুষ দলে দলে ইজতেমা মাঠের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন; মোনাজাত শেষ হওয়ার পর সবাই একসঙ্গে ফিরতে শুরু করায় যানবাহনের সংকটে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। ঢাকার বিমানবন্দর ও গাজীপুরের বিভিন্ন সড়কে ইজতেমা ফেরত হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। ইজতেমা মাঠ থেকে ঢাকার সরাসরি কোনো গণপরিবহণ না থাকায় অনেকে হেঁটেই রওয়ানা হন; কেউ কেউ আবার কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যান ভাড়া করেন। যারা ইজতেমা মাঠে না যেতে পেরে স্টেশন রোড, টঙ্গীর হোসেন মার্কেট, উত্তরা কিংবা বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোনাজাতে অংশ নিয়েছিলেন, তারাও একই সময় ফেরা শুরু করেন। ফলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানীমুখী সড়ক জনস্রোতে পরিণত হয়; তাদের বেশিরভাগই হেঁটে ফিরছিলেন। বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে দূরের যাত্রীদের। তারা যেখানেই যেতে চেয়েছেন সেখানেই গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ থেকে ১০ গুণ ভাড়া।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভৈরব থেকে আসা মুসল্লি সাইফুল ইসলাম, সালমান রহমান ও আরিফ হোসেন রোববার দুপুরে যুগান্তরকে জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে নির্ধারিত ভাড়া আড়াইশ টাকা, অথচ কিছু কিছু বাস সাড়ে ৩শ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। মোনাজাতের পর রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেলে ঢাকার বাসাব যাচ্ছিলেন রায়হান হোসেন ও নজরুল ইসলাম। তারা যুগান্তরকে জানান, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হয়েছে। এছাড়া মিরেরবাজার, পূবাইল, কালীগঞ্জসহ আশপাশে চলাচলরত অটোরিকশা ও ইজিবাইকের চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগণ ভাড়া আদায় করেছেন। পূবাইলের যাত্রী জাহাঙ্গীর আলম ও রাজিব হোসেন জানান, অটোরিকশ ও ইজিবাইকের চালকরা ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা এবং ৩০ টাকার ভাড়া ৬০ টাকা নিচ্ছেন। বাধ্য হয়েই আমাদের এখন যেতে হবে।

যুবায়েরপন্থিদের দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমা করার খসড়া : আয়োজক কমিটির মুরুব্বি ডা. কাজী শাহাবুদ্দিন। তিনি যুগান্তরকে জানান, এবার ময়দানে রেকর্ডসংখ্যক মুসল্লি সমাগম হওয়ায় ময়দান ছাপিয়ে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত অবস্থান নিতে হয়েছে। আগামীতে একপর্বে ইজতেমা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাই ২০২৪ সালের আলমি শূরার বিশ্ব ইজতেমা ৫, ৬, ৭ জানুয়ারি প্রথমপর্ব মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে ১১, ১২, ১৩ জানুয়ারি দ্বিতীয়পর্ব ইজতেমা আয়োজনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করা হবে।

মুসল্লিদের ময়দান ছাড়ার নির্দেশনা : ইজতেমা ময়দানে প্রথম পর্বে অংশগ্রহণকারী সব মুসল্লিকে মঙ্গলবার বেলা ১১টার মধ্যে ময়দান ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি মো. শাহ আলম বলেন, সরকার ও ইজতেমা আয়োজক কমিটির নির্দেশে মঙ্গলবার বেলা ১১টার মধ্যে সমবেত মুসল্লিদের ময়দান ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। এবারের বিশ্ব ইজতেমা সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে স¤‹ন্ন হওয়ায় শুকরিয়া জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান।

৩ হাজার জামাত : ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান বলেন, তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বিদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আখেরি মোনাজাত শেষে বিদেশি ৩শটিসহ ৩ হাজার জামাত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এসব জামাতবন্দির মধ্যে ৪০ দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লিরা রয়েছেন। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবেন।

ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু : গাজীপুর মহানগরের পূবাইলে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত করে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে হাবিবুল (৩২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। রোববার দুপুরে ঢাকা-সিলেট রেললাইনের পূবাইল থানার মাজুখান পশ্চিমপাড়া এলাকায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়। নিহত যুবক কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানার বৈরাগীরচর গ্রামের আব্দুল হাসিমের ছেলে।

২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের অনুসারী (ওয়াসিফুল ইসলামপন্থি) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয়পর্বে অংশ নেবেন। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম