Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন

নতুন বছরেও রাজত্ব করবে ডলার

ডিজিটাল মুদ্রা ডলারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে * আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের উদ্যোগ সফল হয়নি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন বছরেও রাজত্ব করবে ডলার

বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় বড় অর্থনীতির দেশগুলো আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু এতে দেশগুলো খুব বেশি সফল হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের অংশীদারিত্ব কমছে।

বিশ্বের প্রায় সব দেশই মার্কিন ডলারে বেশি রিজার্ভ রাখে। এখন তা আগের চেয়ে একটু কমে এসেছে। এ অবস্থায় ডলারের কদর পুনরুদ্ধারে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর সুদের হার বাড়িয়েই যাচ্ছে। সামনে আরও বাড়ানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এতে ডলার তার আগের অবস্থান কিছুটা উদ্ধার করতে পেরেছে। ডলারের বিকল্প কোনো মুদ্রার সৃষ্টি হয়নি। ফলে নতুন বছরে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের রাজত্ব থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।

আইএমএফের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর বিশ্বের সব দেশের মোট রিজার্ভ ছিল ১২ লাখ ৯২ হাজার কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে ১১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এক বছরে রিজার্ভ কমেছে এক লাখ ৩২ হাজার কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় প্রায় সব দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে বিনিয়োগ। এসব কারণে রিজার্ভ কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশই ডলারে সম্পন্ন হয়। গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২১ টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করেছে। যা পুরো অর্থনীতিকে এলোমেলো করে দিয়েছে। ডলারের চাপ কমাতে বিকল্প মুদ্রায় এলসি খোলার উদ্যোগ নিলেও সাফল্য আসেনি।

চীনা মুদ্রা আরএমবিতে এলসি খোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলার দিলেও তাতে উদ্যোক্তারা আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ পণ্য আমদানির জন্য যথেষ্ট আরএমবি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে নেই। এ ছাড়া রপ্তানিকারকরাও আরএমবিতে এলসি করছেন না। কারণ রপ্তানির মাধ্যমে পাওয়া আরএমবি চীন ছাড়া অন্য কোথায়ও কাজে লাগানো যাবে না। কিন্তু ব্যবসায়িক কাজে তাদের বিভিন্ন দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হয়। সেগুলোতে লাগে ডলার। এ জন্য আমদানি ও রপ্তানিকারকরা ডলারেই বৈদেশিক বাণিজ্য করতে আগ্রহী।

এদিকে ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য করতে আগ্রহী। কিন্তু এখানেও একই সমস্যা। যথেষ্ট রুপি ব্যাংকগুলোর কাছে নেই। ভারতে রপ্তানিও কম। যে কারণে রুপিতে এলসি খোলার বিষয়টি এগুচ্ছে না। রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের সঙ্গে টাকার লেনদেন চালুর বিষয়ে সমীক্ষা করেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগুতে পারছে না।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে এসিইউ ডলারে। এর কোনো ছাপানো মুদ্রা নেই। আছে শুধু কাগুজে মুদ্রা। যা দিয়ে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেন করার পর চূড়ান্ত লেনদেন হচ্ছে ডলারে। আইএমএফ লেনদেন করছে তাদের নিজস্ব মুদ্রা স্পেশাল ড্রইয়িং রাইটে (এসডিআর)। এটির কোনো ছাপানো মুদ্রা নেই। সবই কাগুজে। চূড়ান্ত পর্যায়ে লেনদেন হচ্ছে ডলারে। আশিয়ান দেশগুলোর মধ্যেও এ ধরনের মুদ্রায় লেনদেনে প্রচেষ্টা চলছে।

এদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে ডলারের বিকল্প মুদ্রা উদ্ভাবনের চেষ্টার কমতি নেই। ডলারের প্রভাব কমাতে এসেছে ডিজিটাল মুদ্রা। ইতোমধ্যে বিটকয়েন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এর কোনো নিয়ন্ত্রক নেই বলে এর গ্রহণযোগ্যতা কম। প্রতারিত হলে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। তার পরও বিশ্ব বাণিজ্যের একটি অংশের লেনদেন হচ্ছে বিটকয়েনে। বিট কয়েনের প্রভাব কমাতে চীন ইতোমধ্যে সীমিত আকারে একটি জিডিটাল মুদ্রা বাজারে ছেড়েছে।

গত ১ ডিসেম্বর থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া সীমিত আকারে ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে ছেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও একটি ডিজিটাল মুদ্রা চালুর ব্যাপারে ইতোমধ্যে সমীক্ষা শুরু করেছে। এসব ডিজিটাল মুদ্রা চালু হলে বিটকয়েনের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও লেনদেন করা সম্ভব হবে।

সূত্র জানায়, প্রতিটি দেশই সংকট মোকাবেলায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখে। রিজার্ভের বড় অংশই থাকে ডলারে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছরের আগস্টে সর্বোচ্চ ৪৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এর পর থেকে কমতে থাকে। গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ৩২৫৭ কোটি ডলার। রিজার্ভের সিংহ ভাগই ডলারে রাখা।

আইএমএফের প্রতিবেদনে কোন দেশের মুদ্রায় কি পরিমাণ রিজার্ভ আছে তারও তথ্য দেওয়া হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন ডলারে বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ ছিল সাত লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে তা ছয় লাখ ৪৪ হাজার কোটি ডলারে নেমে এসেছে। একই সময়ে ইউরোপীয় অঞ্চলের দেশগুলোর একক মুদ্রা ইউরোতে বৈশ্বিক রিজার্ভ দুুই লাখ ৪৬ হাজার কোটি ডলার থেকে কমে দুুই লাখ ১২ হাজার কোটি ডলারে নেমেছে। চীনা মুদ্রা আরএমবিতে বৈশ্বিক রিজার্ভ ৩২ হাজার ১২৬ কোটি ডলার থেকে কমে ২৯ হাজার ৭৭৯ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

জাপানি মুদ্রা ইয়েনে বৈশ্বিক রিজার্ভ ৬৭ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার থেকে কমে ৫৬ হাজার ৬৪৩ কোটি ডলার হয়েছে। যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ডে বৈশ্বিক রিজার্ভ ৫৫ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার থেকে কমে ৪৯ হাজার ৭৩৩ কোটি ডলারে নেমেছে। অস্ট্রেলিয়ার মুদ্রা অস্ট্রেলিয়ান ডলারে বৈশ্বিক রিজার্ভ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ২১ হাজার ৪২৪ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে হয়েছে ২০ হাজার ৬২৬ কোটি ডলার হয়। একই সময়ে কানাডার মুদ্রা কানাডিয়ান ডলারে বৈশ্বিক রিজার্ভ ২৬ হাজার ৪২৭ কোটি ডলার থেকে কমে ২৬ হাজার ৪১৫ কোটি ডলার হয়।

ওইসব মুদ্রায় বৈশ্বিক রিজার্ভ কমলেও সুইজারল্যান্ডের মুদ্রা সুইস ফ্রাতে রিজার্ভ বেড়েছে। এ মুদ্রায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ ছিল দুই হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৫০৪ কোটি ডলার।

একই সময়ের ব্যবধানে অন্যান্য দেশের মুদ্রায়ও বৈশ্বিক রিজার্ভ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অন্যান্য মুদ্রায় বৈশ্বিক রিজার্ভ ছিল ৩৫ হাজার ৯৩৬ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে হয়েছে ৩৫ হাজার ৬৪৭ কোটি ডলার।

গত সেপ্টেম্বরের হিসাবে বৈশ্বিক মোট রিজার্ভের ৫৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ ডলারে, ইউরোতে ১৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আরএমবিতে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ, পাউন্ডে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, ইয়েনে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ান ডলারে ১ দশমিক ৯১ শতাংশ, কানাডিয়ান ডলারে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ফ্রাতে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ এবং অন্যান্য মুদ্রায় ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।

জানা গেছে, করোনার সময়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় তিন লাখ কোটি ডলার ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে ওই সময়ে ছাপানো ডলার। মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে তারা এখন ছাপানো ডলারের একটি অংশ বাজার থেকে তুলে নিতে সুদের হার বাড়াচ্ছে। এতে বাজারে ডলারের জোগান কমেছে। ফলে দাম বাড়ছে।

এছাড়া বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব তো আছেই। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডলারের অবস্থান ধরে রাখতে গত ছয় মাসে চার দফায় মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিসুদের হার বাড়িয়ে সাড়ে ৪ শতাংশে তুলেছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে সুদের হার এটিই সর্বোচ্চ। এক বছর আগে এ সুদের হার ছিল দেড় শতাংশের কম। আরও এক দফা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার আভাস ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে।

নীতি সুদের হার বাড়ানোর কারণে ডলারের বিভিন্ন সঞ্চয়ী হিসাবেও মুনাফার হার বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বরে এক মাস মেয়াদি ডলার সঞ্চয়ী বন্ডে সুদের হার ছিল শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একই ধারায় ছিল। মার্চ থেকে এ হার বাড়তে থাকে। এখন তা বেড়ে পৌনে ৪ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে ইয়েনে ছিল শূন্য দশমকি ১০ শতাংশ। এখনো তা অপরিবর্তিত রয়েছে। ইউরোর রেট নেতিবাচক ছিল। গত অক্টোবর থেকে তা বাড়তে শুরু করেছে। এখন তা বেড়ে দেড় শতাংশ হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম