
প্রিন্ট: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৭:৫৫ এএম
সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী আর নেই

সাংস্কৃতিক রিপোর্টার
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী আর নেই। স্বাধীনতা পদকে ভূষিত জাতির এ বীর সন্তান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার সকালে মারা যান (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। আবু ওসমান চৌধুরীর পরিবারের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সহসভাপতি ছিলেন। আবু ওসমান চৌধুরীর পারিবারিক সূত্রে আরও জানা গেছে, কয়েক দিন আগে অসুস্থতার কারণে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষার পর তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। পরে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার করোনাভাইরাস নেগেটিভ আসে। তবে অন্য জটিলতার কারণে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
শনিবার বাদ আসর সেনানিবাসে সেনাকুঞ্জের পাশে সেন্ট্রাল মসজিদে আবু ওসমান চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফন সম্পন্ন হয়।
আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আবু ওসমান চৌধুরীর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। রাষ্ট্রপতি মরহুম আবু ওসমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
পৃথক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আবু ওসমানের বীরত্বপূর্ণ অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়ন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে এ বীর সেনানীর অনবদ্য ভূমিকা সব সময় আমাদের প্রেরণা জোগাবে।
আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে আরও শোক জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, জাতীয় পার্টি-জেপি’র চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম, গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) সাধারণ সম্পাদক ডা. এমএ সামাদ, নাগরিক সংগঠন সুজন।
আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের মদনেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর হন।
১৯৬০ সালে কুমিল্লার মৌলভীপাড়ার মনসুর আহম্মেদের বড় মেয়ে নাজিয়া খানমের সঙ্গে আবু ওসমানের বিয়ে হয়। নাসিমা ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান তাদের দুই মেয়ে। একজন কানাডাপ্রবাসী এবং অপরজন ঢাকাতেই থাকেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়, সেই খবর তিনি কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে বসেই পান। সেসময় তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চতুর্থ উইংয়ের কমান্ডার হিসেবে চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বে। পরদিন সকালে তিনি কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছান এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে একদল সৈনিককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরে তাকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে আবু ওসমান চৌধুরী এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার দেন।
তার স্ত্রী নাজিয়া খানমও সেসময় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে খাবার ও পানীয়, টাকাপয়সা পৌঁছে দেওয়া এবং প্রয়োজনে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দেয়ার মতো কাজ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবু ওসমান চৌধুরীকে লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়, বঙ্গবন্ধু তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) পরিচালকের দায়িত্ব দেন।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের সময় একদল সেনসদস্য আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যার জন্য তার গুলশানের বাড়িতে হামলা করে। বাড়িতে না থাকায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন তার স্ত্রী নাজিয়া খানম।
পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবু ওসমান চৌধুরীকে বিজেএমসির চেয়ারম্যান করা হয়। পরে তাকে চাঁদপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে আবু ওসমান চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।