Logo
Logo
×

ফিচার

মলাট বৃত্তান্ত

চাঁদা ঘুস বখশিস বিষয়ক জটিলতা

Icon

শফিক হাসান

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাগ-ক্ষোভ-দুঃখে মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল জুলফিকার আলমের। ফের ইয়ার্কি! সহ্যের সীমা আছে। সীমার আবার সীমারেখা নেই। যদি থাকত, নিয়মিত মাথা গরম-করা আচরণ করত না। জুলফিকারের বউয়ের নাম সীমা। নামের বিপরীতে প্রায়ই লাগামছাড়া ভাব প্রদর্শন করে। এই যেমন এখন। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, ব্যস্তসমস্ত সময়েই কিনা সীমা বলে উঠল, ‘পেঁয়াজ শেষ। টাকা দিয়ে দাও। আমিই কিনে আনব।’

ক্রোধ চেপে জুলফিকার বলল, ‘ভুলে গেলে, গতকাল ৬৫ টাকায় তোমাকে অর্ধকেজি পেঁয়াজ কিনে দিয়েছি!’

নির্বিকার ভঙ্গিতে সীমা বলল, ‘তাহলে রসুন শেষ হয়েছে। ৩০০ টাকা দিলে চলবে। চীনা রসুন কিনব!’

এক রুমের সাবলেট বাসায় কোনোকিছু খুঁজতে বেগ পেতে হয় না। চৌকির নিচ থেকে পেঁয়াজ-রসুনের ক্যারটটা বের করল জুলফিকার। সামনে রেখে বলল, ‘এসব কী? কেনাকাটার নামে তুমি আমার পকেটকাটায় বেশি উৎসাহী। কেন?’

সীমার চেহারায় চোর-চোর ভাব, অপরাধবোধ কোনোটাই ফুটল না। উল্টো চেঁচিয়ে উঠল, ‘অত হিসাবনিকাশ বুঝি না। টাকা লাগবে। ক্যাশ, ব্যস!’

‘টাকার গাছ লাগিয়েছি। বড় হোক। ছিঁড়ে নিতে পারবে।’

বেরুনোর সময় দড়াম প্রতিধ্বনিতে দরজা বন্ধ করল। শব্দটা পৌঁছাল নিশাত ভাবির কান পর্যন্ত। বাসাটা তারই। স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন অন্য দুই রুমে। নিশাত ভাবি বললেন, ‘সীমা ভাবি কিছু বলেছেন?’

‘বলেছে। ওর টাকা লাগবে। ক্যাশ!’

‘আমার কথা বলছি।’

‘ভাড়া পরিশোধ করেছি তো।’

‘আগামী মাস থেকে ভাড়া ৫০০ টাকা বাড়বে। সাড়ে ছয় হাজার।’

‘বাসায় উঠলাম দুই মাস হলো। এখনই ভাড়া বাড়াবেন?’

‘বাজারমূল্যের খবর রাখেন? দেখেন, আপনার পোষায় কিনা। আমার ভাড়াটিয়ার অভাব হয় না...।’

চুলগুলো এবার সজারুর কাঁটায় রূপ নিল। বলল, ‘দেখেন, যা ভালো মনে করেন!’

ভাঙ্গাচোরা প্রধান ফটকে একজন দারোয়ান থাকে। জুলফিকারকে এগিয়ে আসতে দেখে কেলানো হাসি দিয়ে বলল, ‘ছার, বিশটা ট্যাকা দ্যান। ছা-পান খামু।’

‘তোমরা কেউ চা খাবে, কেউ ভাড়া খাবে, কেউ আরাম খাবে- আর আমাকে খেতে হবে বিষ? এভাবে মুদ্রাস্ফীতি চলতে থাকলে বিষই খেতে হবে।’

‘থাক ভাই। ট্যাকা লাগব না। বিশ ট্যাকার বিষ কিইন্যাই খান!’

পেছন থেকে শুনতে পেল দারোয়ানের ব্যঙ্গোক্তি, ‘হালায় ফইন্নির ঘরের ফইন্নি!’

অপমানের এখানেই শেষ নয়। কম দূরত্বে জায়গাটুকু হেঁটেই আসে সে। তারপর বাসে ওঠে। আজ সময় বাঁচানোর তাগিদে অটোরিকশায় চড়ল। নেমে ৩০ টাকা চালকের হাতে দিয়ে তিন কদমও যেতে পারল না। অটোচালক ডাক দিল, ‘আরও ১০ ট্যাকা দ্যান, ছার।’

‘কেন! রেট ভাড়াই দিয়েছি।’

‘বকশিস দিবেন না? শুধু ভাড়ায় চলব!’

‘বকশিস কি চেয়ে নেওয়ার জিনিস?’

‘আপনে দেন নাই বইলাই তো চাইলাম। গাড়ি বাতাসে চলে না, কারেন্ট লাগে। এখন আবার শুরু অইছে লোডশেডিং।’

‘সেটাও আমার অপরাধ?’

শর্টসার্কিটে তার পোড়ার মতো জ্বলে উঠল অটোচালক, ‘না, আপনে ফকফকা। আমারই দোষ। বউনির খ্যাপে কাইস্টা তুললাম। দিনডাই মাডি। সারাদিন ছালি খামু!’

ঘেমে-নেয়ে অফিসে ঢুকতেই পিয়ন এসে বলল, ‘বড় স্যার সালাম দিয়েছেন আপনাকে।’

ঘাম আরও বাড়ল। সেটা লক্ষ করে পার্শ্ববর্তী সহকর্মী বলল, ‘পিয়ন ব্যাটাই স্যারের কানে বিষ দিয়েছে। প্রতিদিনই তুমি নাকি দেরিতে আসো। কতবার বলেছি- ওকে দুই-একশ টাকা বকশিস দিও। মনে করবে এটা শান্তি-চাঁদা!’

‘ঘুস দেব কানকথার ভয়ে!’

‘কেন দেবে না। সবাই দেয়। যাও, এখন ঠেলা সামলাও। নতুন হিসাব খুলে আসো!’

এমডির রুমে বসে আছেন জনৈক ভদ্রলোক। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘উনি লাইফ-হ্যাভেন বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান। আপনার একটা পলিসি করিয়ে দিই এই কোম্পানিতে? দশ বছর পর তিনগুণ রিটার্ন পাবেন।’

জুলফিকার কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘এত টাকা কোথায় পাব?’

‘টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমিই দিয়ে দেব। মাস শেষে আপনার বেতন থেকে কাটা যাবে। মনে করেন এটা আমার কর্মী-সেবা।’

যুগপৎ লজ্জা-গ্লানির চাপে জুলফিকারের মাথা কাটা গেল যেন। কোনোমতে বলল, ‘একটা ইনক্রিমেন্ট পেলে ভালো হতো, স্যার। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি!’

‘অফিসে কোন ঘোড়ার ডিম পাড়েন? চাকরি আছে, এটাই বেশি। যান, আপনাকে বীমা করতে হবে না।’

সন্ধ্যায় চড়ামূল্যে আনাজ-তরকারি কিনল জুলফিকার। বাসার গেটে টুলেট ঝুলছে।

সাবলেট ভাড়া হবে

ছোট পরিবার

নিশাত ভাবি এমন অর্থ-পিশাচী! ওর চুন আনতে পান ফুরায় অবস্থা জেনেও লোভ করতেই থাকেন! ভেতরে কোথাও সীমাকে দেখা গেল না। চৌকির উপরে মিলল ‘টেলিগ্রাম’-

আমি গেলাম।

তুমি থাকো পেঁয়াজ-রসুন আর হিসাবনিকাশ নিয়ে।

বিমূঢ় অবস্থাতেই ফোনকল বাজল। শ্যালিকা! জুলফিকার দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘তোমার আপু কোথায়?’

খিলখিল হাসিতে কাচ ভাঙল যেন, ‘ওসব জানি না বাপু! লেটেস্ট ডিজাইনের ফোর-পিসটা এবারও কিনে দেবেন না?’

‘থ্রিপিসের কথা বলেছিলে!’

‘এখন আমি বড় হয়েছি না? অন্তরে বাহিরে...।’

‘ঘরে-বাইরে সবাই মিলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ?’

‘আরে না, হোয়াইটমেইল। আপনি সাদামনের মানুষ। মেইল ট্রেনের যুগেও ঠেলাগাড়ির যাত্রী হওয়াই লক্ষ্য হয় কেন!’

‘থ্রি-ফোরপিস কিছুই দিতে পারব না। প্রয়োজনে তোমরা আমাকে পিস পিস করে কেটে ফেলো!’

মোবাল ফোন হাত বদল হলো। এরপর শাশুড়ির বকা শুনে সংজ্ঞা হারাল জুলফিকার। একসপ্তাহ পরে চাকরিটাও। সীমা ফেরেনি, নতুন ভাড়াটিয়া অ্যাডভান্স করে গেছে!

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম