Logo
Logo
×

স্বপ্নদ্রষ্টার স্মরণে

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম

স্বপ্নের বরপুত্র

Icon

রেজাউদ্দিন স্টালিন

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নের বরপুত্র

সব মানুষের স্বপ্ন থাকে। সব স্বপ্নের মূল্য আছে। কিন্তু সব স্বপ্ন সাফল্যের দরজায় করাঘাত করতে পারে না। তাহলে শুধু স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের প্রয়োগ দরকার। আক্ষরিক অর্থে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ। এরকম জীবনজয়ী স্বপ্ন দেখছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। তিনি এ দারিদ্র্যপীড়িত জনপদকে স্বয়ম্ভর করতে চেয়েছিলেন। কর্মসংস্থান তৈরিতে আমৃত্যু কাজ করেছেন এবং ৪১টি প্রতিষ্ঠান নির্মান করেছেন। সবচেয়ে আলোচিত কাজটি তার যমুনা ফিউচার পার্ক। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি

শপিংমল আর কমপ্লেক্স থাকবে, বিনোদন কেন্দ্র থাকবে-নারী শিশুসহ সব মানুষ এখানে এসে প্রশান্তি লাভ করবে, এ ছিল তার চাওয়া। সবার চাওয়া কি পূর্ণ হয়? হয় না। কিন্তু নুরুল ইসলামের চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। তিনি দেখে গেছেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য লড়াই করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম জীবনের শেষ মুহূর্তেও লড়েছেন মৃত্যুর সঙ্গে। আজীবন লড়াকু স্বপ্নবাজ সংগ্রামী ও মানবদরদি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে তিনি সফল। প্রত্যেক শিল্পপতিই জানেন যে, ব্যবসাসফল হওয়া কতটা কঠিন অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার কাজ। কত রক্ত ঘামের বিনিময়ে পাওয়া যায় ইপ্সিত গন্তব্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যথার্থ বলেছেন-অনেকে অসাধু উপায়ে উপার্জন করেন এবং দেশের বাইরে পাচার করেন-নুরুল ইসলাম ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি সৎপথে উপার্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করেছেন, হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তিনি ছিলেন দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের রোল মডেল। আমরা কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের মন্তব্যকে প্রণিধানযোগ্য মনে করি। যেমন নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ যখন বলেন-তিনি চ্যালেঞ্জ নিয়ে গণমাধ্যম গড়ে তুলেছেন। তখন আমরা দেশের সেরা কাগজ দৈনিক যুগান্তরের সাফল্যের দিকে তাকাই। নির্ভীক এবং নিরপেক্ষ সৎ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যুগান্তর। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার মুক্তির প্রসার ঘটাতে তিনি টিভি চ্যানেল ‘যমুনা’ প্রতিষ্ঠা করেন। যখন কথা বলতে, সত্য উচ্চারণে অনেক গণমাধ্যম ভয় পায় তখন আমরা দৈনিক যুগান্তরকে দেখি প্রিন্ট মিডিয়ার জগতে এক উজ্জ্বল বাতিঘর। আমরা দেখি যমুনা টিভির সাহসী প্রতিবেদন। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন-তিনি কঠোর পরিশ্রম করে বহুমুখী শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান দিয়েছেন। এ কারণে তিনি মেহনতি মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।

আমি আহমেদ আকবরের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করি। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মের সারাৎসার ও দূরদৃষ্টির জন্য। আগামী একশ বছর পরের বাংলাদেশ নিয়েও তিনি ভাবতেন। তার আরও স্বপ্ন ছিল বড় হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনুরাগী মানুষ ছিলেন তিনি। আইএস ইডি-এর সচিব জনাব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ খাঁন বলেন-এরকম শিল্প উদ্যোক্তা কিংবা স্বপ্নবান মানুষ সব সময় জন্মে না, তারা ক্ষণজন্মা।

প্রকৃতপক্ষে নুরুল ইসলাম একজন ক্ষণজন্মা। আমরা যাকে কাজের মানুষ বলি-তিনি ছিলেন তাই। কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দাশ লিখেছিলেন-‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ যদি কুসুম কুমারী দাশ বেঁচে থাকতেন তাকে প্রণাম করে বলতাম দেখুন মা, আপনার দেশে এরকম ছেলেরা জন্মেছে, যারা কথায় না কাজেও বড় হয়েছে। কী নেই তার, আছে মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, আছে অঢেল সম্পদ, আছে বীরত্বগাথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত দেশপ্রেম। আবারও জীবনানন্দ দাশের বাংলার মুখ কবিতার কথা মনে পড়ে-‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ নুরুল ইসলাম এই জল হাওয়া কাদামাটির সবুজ সরল মাতৃভূমির বাংলার মুখ দেখেছিলেন গভীরভাবে; সেজন্য তিনি আর অন্য দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিতে চাননি, তিনি অন্য দেশের ব্যাংকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রেখে আনন্দবোধ করেননি। বরং এ দেশের মধ্যে প্রোথিত করেছিলেন তার ভালোবাসার শিকড়। কিছুদিন আগে যুগান্তর কার্যালয়ে কবি লুব্ধক মাহবুবের কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার উপলব্ধি আরও দৃঢ় হলো। দেখা হলো নুরুল ইসলামের সহধর্মিণী সালমা ইসলামের সঙ্গে। তিনি যমুনা গ্রুপের কর্ণধার, সংসদ-সদস্য, আইনজীবী এবং একজন সংগীত শিল্পীও। কবি জসীমউদ্দীন কৈশোরে সালমা ইসলামকে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন, সেটি তিনি ওই অনুষ্ঠানে মুখস্থ পড়লেন। তখন বুঝলাম একজন সংস্কৃতিমনা কবিপ্রাণ মানুষের সঙ্গে নুরুল ইসলাম সংসার পেতেছিলেন। আরও কত স্বপ্ন ছিল নুরুল ইসলামের তার অনেকটাই এখনো পূর্ণ হয়নি। বাকিটা পূর্ণ করার ভার বর্তেছে তার সুযোগ্য স্ত্রী নারীনেত্রী সালমা ইসলামের ওপর। তিনি নুরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা করছেন এবং নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। তার পাশে আছেন নুরুল ইসলামের সুযোগ্য সন্তানরা। যতদূর জানি তারা পিতার স্বপ্নকে বহন করে চলেছেন। নুরুল ইসলামের সঙ্গে কাজ করেছেন যারা তারা যে তার কত ভক্ত ও অনুরক্ত তা বোঝা যায়। দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিকরা নুরুল ইসলামের স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানকে মেধা ও শ্রম দিয়ে শীর্ষস্থানীয় কাগজ করে তুলেছেন। আসলে অনুসারী ও ভালোবাসার মানুষ তৈরি করার কারিগর ছিলেন নুরুল ইসলাম। তিনি হিমালয় থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বাংলার রূপরস ও প্রকৃতির মধ্যে নিজের স্বপ্নকে ঢেলে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। রাজধানী ঢাকায় স্বপ্নের বীজ বুনেছেন যা সারা দেশের মানুষের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হননি, মৃত্যুই তার কাছে পরাজিত। তিনি এক কর্মবীর স্বপ্নের বরপুত্র। আজ তাকে স্মরণ করতে পেরে গৌরববোধ করছি।

লেখক : কবি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম