শিল্পায়নের প্রয়োজনটা অনুভব করেছিলেন
ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান জনাব নুরুল ইসলাম একজন সফল স্বদেশি শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি একজন স্বউদ্যোগী মাটিঘেঁষা উদ্যোক্তা ছিলেন। শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে দিন-রাত পরিশ্রম করে বিরাট শিল্প গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন।
নিঃসন্দেহে প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি খাত, বিশেষ করে বস্ত্র খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় দুই খুঁটি। কিন্তু আমাদের আমদানি-বিকল্প দেশি শিল্প খাতের বিরাট ভূমিকার কথা ভুললে চলবে না। আশার কথা যে, এ খাতের গুরুত্ব আমাদের বাজেট প্রণেতারা কখনোই ভোলেননি। বরং এ খাত যাতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখে টিকে থাকতে পারে সে জন্য নানামুখী শুল্ক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। চলতি বাজেটেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তাছাড়া আমাদের বিশ্বসেরা রপ্তানি শিল্প-কারখানার জন্য যেসব কাঁচামাল ও মধ্যম পর্যায়ের উপকরণ দরকার হয় তার প্রায় পুরোটাই এখন দেশের ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্পোদ্যোক্তারাই উৎপাদন ও সরবরাহ করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা এখন রপ্তানিকারক হিসাবেও আবির্ভূত হচ্ছেন। এ উদ্যোক্তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে দেশের ব্যাংকিং খাতের ভূমিকাও অসামান্য। অনেকটা হাতে ধরে তাদের বিকাশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাংকগুলো অনেক ঝুঁকি নিয়েই সহায়তা করেছে। এসব উদ্যোক্তা লেগে থেকে থেকে নিজেদের গড়ে তুলেছেন। তারা যখন বড় হচ্ছিল তখন ব্যাংকগুলোই তাদের করপোরেট শাসনব্যবস্থার অভাব অনেকটাই পূরণ করেছে। তারাও তাদের পরের প্রজন্মকে উচ্চশিক্ষিত করে এনে এসব উদ্যোগে যুক্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও হিসাব-নিকাশ পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনায় ঘাটতি থেকেই গেছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা নানাভাবে তাদের এ অসম্পূর্ণতা পূরণে সর্বদাই চেষ্টা করেছেন। এসব উদ্যোক্তার মধ্যে কেউ কেউ আবার স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের প্রতি সরকার ও ব্যাংকের সহায়তার সুযোগের অপব্যবহারও করেছেন। অবশ্যি এসব প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত আর টেকেনি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়ে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া উদ্যোক্তাদের সার্বিক ভাবমূর্তিকেই বরং কালিমা লিপ্ত করেছেন। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকেও বিপদে ফেলেছেন। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের দেশি উদ্যোগগুলোর বিকাশের ধারা থেকে ব্যাংকগুলো সরে দাঁড়ায়নি। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নানা রেগুলেটরি সৃজনশীলতা ও সহিষ্ণুতা দেখিয়ে এসব দেশি উদ্যোগকে বিকশিত হওয়ার পথ করে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে কোভিড সংকটে পড়ে অনেক শিল্পোদ্যোক্তা প্রায় পথে বসার সংকটে পড়ে গিয়েছিল। সে সময়টা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কোভিড-উত্তরকালে এদের অনেকেই ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের এ দেশজ শিল্পায়নের অভিযাত্রায় উদ্যোগী রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকিং খাতের ব্যাপক অবদানের কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রথমদিকে শিল্পোদ্যোক্তাদের নানা অসংগতি থাকে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। কিন্তু এদের মধ্য থেকেই এসব অসংগতি কাটিয়ে উঠে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যের বহুমুখিনতার দিকে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
এতক্ষণ ধরে দেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের বেড়ে ওঠার যেসব প্রবণতার কথা বললাম সে সবের অনেকই যমুনা গ্রুপের প্রাণপুরুষ নুরুল ইলামের মাঝে লক্ষ করা যেত। তাছাড়া তার অনুপস্থিতিতেও তার পরিবারের সদস্যরা যেভাবে তাদের নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রুপটির কার্যক্রম শুধু অব্যাহত রেখেছেন তাই নয়, তাদের উদ্যোগগুলোকে আরও আধুনিক ও বহুমাত্রিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা নিশ্চয় চোখে পড়ার মতো।
একথা বললে ভুল হবে না যে, যমুনা গ্রুপের গোড়াপত্তন করে নুরুল ইসলাম লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তার এ উদ্যোগের সঙ্গে অনেক ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তা যুক্ত হয়েছেন। সেখানেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কোভিডের ধাক্কায় তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তার তৈরি উদ্যোগগুলো পথ হারায়নি। এখনো তার উত্তরসূরিদের অদম্য উদ্যম ও তার স্মৃতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা যে কারও দৃষ্টি কাড়বেই।
যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময়। তিনি তার সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা বলতে আসতেন। আমি তাকে সব সময় তার তৈরি উদ্যোগগুলোতে করপোরেট শাসনব্যবস্থার গুরুত্বের কথা বলতাম। পরেও এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। নিশ্চয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তার সন্তানেরা এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। যদি এ দিকটায় তারা কড়া নজর রাখেন তাহলে যমুনা গ্রুপের অগ্রযাত্রা নিশ্চয় অব্যাহত থাকবে।
দেশের ভেতরে নানামুখী শিল্পকারখানা ও ব্যবসায়ী উদ্যোগ চালু করে নুরুল ইসলামের বাংলাদেশে বিপুলসংখক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টিকেই আমি বেশি গুরুত্ব দেব। দেশের ভেতর যে শিল্পায়নের প্রয়োজন সেটি তিনি অনুভব করেছিলেন। সংগ্রামী এ মানুষটির মনের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মতো অনুপ্রেরণা ও লেগে থাকার শক্তি বরাবরই ছিল। এ দুই গুণের সম্মিলনেই তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছিলেন। তিনি পুঁজিকে একদিকে নয়, নানা দিকে বিনিয়োগ করেছেন। আর তার সুফল যমুনা গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ভোগ করছেন। তিনি খুবই সাধারণ অবস্থা থেকে লড়াই করে করে এ জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল গভীর। তার উত্তরসূরিরা নিশ্চয় তার এ সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি মনে রাখবেন এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সংকটে ও সম্ভাবনায় একযোগে কাজ করে যাবেন। তবেই না তার আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর