এ সংকটকালে মনে পড়ছে তার কথা
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে বিশিষ্ট শিল্পপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব নুরুল ইসলামের কথা মনে পড়ছে। এ অর্থনৈতিক সংকটের একটি বড় কারণ ডলার সংকট। এ সংকটের প্রধান কারণগুলো বহুল আলোচিত। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্সপ্রবাহে কাঙ্ক্ষিত গতি আসছে না। এ প্রেক্ষাপটে রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে, একই সঙ্গে রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণেও গুরুত্ব বাড়াতে হবে। অর্থনীতিতে ডলার সংকটের প্রভাব বহুমুখী।
উদাহরণ হিসাবে জ্বালানি সংকটের কথা উল্লেখ করা যায়। এ সংকটের সঙ্গে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন সরাসরি জড়িত। ডলার সংকটের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর শিল্পগুলো সংকটে পড়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা। কারণ তাদের অনেকে নির্ভর করেন যেসব ব্যবসায়ী বাণিজ্যিকভাবে কাঁচামাল আমদানি করেন তাদের ওপর। সাধারণত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সরাসরি কাঁচামাল আমদানি করেন না। নতুন সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদেরও সরাসরি কাঁচামাল আমদানির উদ্যোগ নিতে হচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারায় উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে, নতুন কর্মসংস্থানেও এর প্রভাব পড়েছে। বস্তুত দেশের শিল্প খাতকে সাম্প্রতিক সময়ে একধরনের বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আশা করা যায়, এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুতই উত্তরণ ঘটবে।
এ সংকট আমাদের যে বার্তা দিল তা হচ্ছে, আমরা যদি বিভিন্ন খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারি, তাহলে যে কোনো সময় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নতুন নতুন সংকট দেখা দিতে পারে। আমাদের মতো জনবহুল দেশের বিভিন্ন খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা কতটা জরুরি তাও বহুল আলোচিত।
দূরদর্শী উদ্যোক্তারা দেশের শিল্প খাতের বিভিন্ন সংকট সম্পর্কে বহু আগেই ধারণা করতে পেরেছেন এবং শিল্প খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তেমনই একজন সফল উদ্যোক্তা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা জনাব নুরুল ইসলাম। আমদানিনির্ভরতা পরিহার করে বিভিন্ন খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কাজটি সহজ নয়। যেসব উদ্যোক্তা দেশের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা তাদের অন্যতম। আজ থেকে চার দশক আগে আমাদের দেশের নতুন উদ্যোক্তাদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হতে হয়েছে, সেসব তথ্য তরুণ উদ্যোক্তাদের জানানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। শিল্পপতি জনাব নুরুল ইসলাম সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন; একই সঙ্গে তিনি অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
জানা যায়, আগামী বছর বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়বে কি না, তা বলা মুশকিল। বস্তুত আমদানিনির্ভরতা কমানো না গেলে এবং দেশের রপ্তানি খাতকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শক্তিশালী করা না গেলে বারবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। কাজেই এ সংকট থেকে উত্তরণের পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তারা, বিশেষত তরুণ উদ্যোক্তারা যাতে যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা নুরুল ইসলামের মতো সফল হতে পারেন, তেমন পরিবেশ সৃষ্টির জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে।
২.
শিল্পপতি নুরুল ইসলামের জন্ম ঢাকার নবাবগঞ্জে। তিনি ছিলেন একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত নবাব। একের পর এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তিনি শিল্প খাতের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশ থেকে আধুনিক প্রযুক্তি আমদানি করে দেশে বিশ্বমানের শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার দূরদর্শী চিন্তা, প্রগতিশীল মনোভাব ও নিরলস পরিশ্রমের ফসল আজকের যমুনা গ্রুপ। টেকসই মানের কারণেই যমুনা গ্রুপের পণ্য ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
৩.
ব্যতিক্রমী গুণের কারণেই বৈচিত্র্যময় ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে জনাব নুরুল ইসলাম সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। বিচক্ষণতা, একাগ্রতা, স্বচ্ছতা, কর্মীবান্ধব নীতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সর্বোপরি কঠোর পরিশ্রমের কারণেই তিনি এমন সাফল্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তিনি বিপুলসংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান করেছেন। বর্তমানে যমুনা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক কর্মী কর্মরত রয়েছে।
জনগণের তথ্যচাহিদা পূরণের বিষয়েও সচেতন ছিলেন নুরুল ইসলাম। বস্তুত দেশের মানুষের সেবার ব্রত নিয়েই তিনি দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন; যে দুটি প্রতিষ্ঠান এখন বেশ জনপ্রিয়। একজন ব্যক্তি যখন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন, তখন তিনি লাভালাভের চিন্তা না করে একজন সুনাগরিকের ভূমিকা পালন করেন। প্রকৃতপক্ষ একজন মানুষ যদি সততার সঙ্গে সদিচ্ছা নিয়ে পরিশ্রম করেন, তাহলে প্রায় শূন্য অবস্থা থেকে কত দ্রুত খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করা সম্ভব, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নুরুল ইসলাম। যমুনা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে লক্ষাধিক কর্মী কর্মরত রয়েছেন, তাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের আরও অনেক মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
ব্যবস্থাপনায় সুবিধার কথা বিবেচনা করে অনেক উদ্যোক্তা একই অঙ্গনে বা এলাকায় একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করে থাকেন। এদিক থেকেও নুরুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রমী। একই এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলেও যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালনা করা যায়, এটিও তিনি প্রমাণ করেছেন। অবকাঠামোগত সুবিধাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এটিও তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তারই একটি বিশেষ দিক।
৪.
যারা বিদেশে গিয়ে কেনাকাটা করতেন, যমুনা ফিউচার পার্ক প্রতিষ্ঠার পর কেনাকাটার জন্য তাদের এখন আর বিদেশে যেতে হয় না। এ প্রতিষ্ঠানের এক অঙ্গনে মানুষ এখন বহুমুখী সেবা পাচ্ছে, যা এতদিন তারা শুধু কল্পনাই করত। এ পার্কে যুক্ত হওয়া হোলসেল ক্লাব-দেশের সর্ববৃহৎ হাইপার মার্কেট-অল্প সময়ে দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। হোলসেল ক্লাবের উদ্বোধনী অনুুষ্ঠানে নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, এক ছাদের নিচে ন্যায্যমূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া আমাদের অঙ্গীকার। এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের ৫ শতাধিক পণ্য গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ওইদিন তিনি আরও বলেছিলেন, শুরু থেকে মানুষের সেবা করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকি সেবা করে যাব।
শুনেছি, হোলসেল ক্লাবের ‘বুক কর্নারে’ দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য গুণিজন ও খ্যাতিমান লেখকের গ্রন্থ কেনার সুব্যবস্থা রয়েছে। আজকাল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সময়ের অভাবে অনেকে বই কেনার জন্য পছন্দের বইয়ের দোকানে যেতে পারেন না। এমন ব্যস্ত মানুষ হোলসেল ক্লাবে গিয়ে কেনাকাটা করে ফেরার সময় বই কেনার সুযোগও পাবেন। আশা করি, হোলসেল ক্লাবের ‘বুক কর্নার’ মানুষকে বইমুখী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মানুষকে যত বেশি বইমুখী করা যাবে, সমাজে উচ্চ মূল্যবোধে ও নৈতিকতার চর্চায় তত বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুনেছি, যমুনা ফিউচার পার্কে নির্মাণাধীন রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের একটি হোটেল। আশা করা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান দেশের পর্যটন খাতের বিকাশেও অবদান রাখবে।
৫.
জনাব নুরুল ইসলামের সন্তানরা দেশে-বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ করে বাবার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, আশা করা যায় তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় যমুনা গ্রুপের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। প্রতিটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন নুরুল ইসলাম। তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের এ বার্তাটি দিয়ে গেছেন যে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে কোনো মূল্যে পণ্যের উচ্চমান নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখে নুরুল ইসলাম যেভাবে একটির পর একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তরুণ উদ্যোক্তারা তেমন মনোভাব নিয়ে পরিশ্রম করলে সফল হতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।
দুঃখের বিষয়, তিনি তার অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই আকস্মিকভাবে অকালে চিরবিদায় নিয়েছেন। আমি আশা করব, তার উত্তরসূরিরা তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তরুণ উদ্যোক্তারা নুরুল ইসলামকে অনুকরণ করলে তারা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এবং দেশের কল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চেয়ারম্যান, বাসস