Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

সিআইডির অনুসন্ধানে বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

বেশি প্রাণহানির কারণ এমব্রোসিয়া রেস্তোরাঁ

এখনো অধরা রেস্তোরাঁটির কর্তৃপক্ষ * আইনের আওতায় আনা হবে সংশ্লিষ্ট রাজউক কর্মকর্তাদের

Icon

ইমন রহমান

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি কাগজে-কলমে সাততলা হলেও বাস্তবে ছিল আটতলা। ভবনের ছাদে নিয়মবহির্ভূতভাবে তৈরি করা হয় এমব্রোসিয়া নামের একটি রেস্তোরাঁ, যার ছাদ করা হয় ফলস বোর্ড দিয়ে। ঘটনার রাতে ভবনের নিচতলায় যখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল তখন ধোঁয়া উঠতে থাকে উপরের দিকে। আটকে পড়া অনেকে দৌড়ে ছাদে উঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা এমব্রোসিয়া রেস্তোরাঁয় আটকা পড়েন। বের হওয়ার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে অনেকে আবার নিচে নামেন। মূলত সাততলা ভবনটিতে একদিকে ছিল না কোনো বিকল্প সিঁড়ি, অন্যদিকে ছাদ দখল করে গড়ে তোলা হয় রেস্তোরাঁটি। আগুনে রেস্তোরাঁর ফলস বোর্ড দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। আগুন লাগার পর মানুষ দ্রুত ছাদে উঠতে পারলে প্রাণহানি অনেক কম হতো বলে মনে করছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এদিকে যে এমব্রোসিয়া রেস্তোরাঁর কারণে এত প্রাণহানি সেই রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি।

সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভবনের নকশায় দুটি সিঁড়ি থাকলেও নির্মাণ করা হয় একটি। শুধু এখানেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। ভনটির পাঁচতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও এর উপরে আবাসিকের অনুমোদন থাকলেও পুরোটাই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এতসব নিয়মের ব্যত্যয় হলেও দেখভালের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। তাই ভবন নির্মাণের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিদর্শকসহ যেসব কর্মকর্তা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে। এ কার্যক্রমের সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের নামের তালিকা রাজউকের কাছে চেয়েছে সিআইডির তদন্ত দল। এছাড়া গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের সঙ্গে নাশকতার কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি, অসতর্কতা থেকেই ঘটে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ড। এমন তথ্যই বলছে সিআইডি।

ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) আদালতে জমা দিতে পারেনি সংস্থাটি। এর কারণ হিসাবে তদন্তকারীরা বলছেন, রাজউক ও আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিবেদন না আসায় চার্জশিট জমা দিতে পারছেন না। ৩ মাস ধরে ওই প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন তারা।

জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আনিচুর রহমান বলেন, ‘মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি খুব দ্রুতই তদন্ত শেষে প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারব।’

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি (২০২৪ সাল ছিল অধিবর্ষ) রাত পৌনে ১০টার দিকে গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগে। এতে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। এ ঘটনায় গত বছরের ১ মার্চ রাতে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শহিদুল ইসলাম রমনা মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে চুমুক ফাস্টফুডের মালিক আনোয়ারুল হক, ভবনের স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ভবনের ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর মালিক সোহেল সিরাজসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ভবনের নিচ তলায় চুমুক নামের ফাস্টফুডের দোকান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। বিস্ফোরণে সৃষ্ট প্রচণ্ড ধোঁয়া দ্রুতই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়। পাঁচ সদস্যের এই কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’ নামের ফাস্টফুডের দোকানের ইলেকট্রিক চুলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শর্টসার্কিট) থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকায় মানুষ চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি।

এ ঘটনায় হওয়া মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে সিআইডি। এখন পর্যন্ত এ অগ্নিকাণ্ডে আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন, ভবনের ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, চুমুক ফাস্টফুডের মালিক মো. আনোয়ারুল হক, ফাস্টফুডটির ম্যানেজার শফিকুর রহমান, কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর ম্যানেজার জেইন উদ্দিন জিসান, রেস্তোরাঁটির মালিক সোহেল সিরাজ, ফুকো রেস্তোরাঁর মালিক আব্দুল্লাহ আল মতিন এবং অন্য দুটি রেস্তোরাঁর মালিক মোহন আলী পলাশ ও মো. নজরুল ইসলাম খান।

তবে গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে এত বেশি প্রাণহানির নেপথ্যে ছিল যে এমব্রোসিয়া রেস্তোরাঁ, তার মালিক এখনো অধরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেস্তোরাঁটির মালিক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। এটি চালাতেন তার ছেলে (ম্যানেজার)। আগুনের ঘটনায় ভবনটির অন্যান্য রেস্তোরাঁ মালিক ও ম্যানেজার গ্রেফতার হলেও এমব্রোসিয়া রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর কারণ জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি সিআইডি। তবে নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা বলেন, মিজানুর রহমান অসুস্থ থাকায় তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) শাহজালাল মুন্সি বলেন, এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তারা কারাগারে আছে, না জামিন পেয়েছে তা সঠিক জানা নেই।

তিনি বলেন, মোট ১২টি সংস্থার কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। এরমধ্যে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, তিতাস গ্যাস, প্রধান বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ ১০টি সংস্থার প্রতিবেদন পেয়েছি। সেসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, দুটি সংস্থার প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। রাজউকের নকশায় কি ছিল, নকশা মোতাবেক কাজ করা হয়েছে কিনা, যদি না হয়ে থাকে তাহলে রাজউক কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা, কোন কোন কর্মকর্তা ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের নামের তালিকাসহ সার্বিক বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। আংশিক প্রতিবেদন তারা দিয়েছে, কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়।

তিনি আরও বলেন, ‘ভবনটিতে খোলা ছাদ থাকলে এত মানুষ মারা যেত না। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে আরও ৩ মাস সময় লাগতে পারে বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের আগেও রাজধানীর বিভিন্ন ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। এরমধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে মারা যান ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আর ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে মারা যান ১২৪ জন। এসব ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলার বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভয়াবহ সব অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানি যেন ঘটেই চলেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম