নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
জাতীয় নাগরিক পার্টির ঘোষণাপত্র : বিশেষজ্ঞ অভিমত

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা এবং নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের মৌলিক দাবি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ কয়েকজন বিশ্লেষক এ বিষয়ে যুগান্তরের কাছে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মতামত দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি অনেকে মানতে চাননি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক এ প্রসঙ্গে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, নতুন দলের উদ্যোক্তা অর্থাৎ ছাত্ররা সেকেন্ড রিপাবলিক তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র শব্দটা কোথায় পেল তা আমার মাথায় আসছে না। তারা হয়তো ফ্রান্সের উদাহরণ দেবেন। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা আর ফ্রান্সের বাস্তবতা এক না। ফ্রান্সের ইতিহাস দীর্ঘ দেড়শ বছরেরও বেশি। সেখানে রাজতন্ত্র ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা ছিল। ফ্রান্সে একবার রাজাকে উৎখাত করা হয়েছে। আবার রাজা ফিরে এসেছে। নতুন করে আবার রাজাকে উৎখাত করা হয়েছে। এভাবে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে এখন পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে রাজতন্ত্র নেই। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থারও মুখোমুখি হতে হয়নি আমাদের। তাই সেকেন্ড রিপাবলিক তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র শব্দটা আমাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। একইভাবে নতুন সংবিধান প্রণয়নে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছে ৪ বছর। পাকিস্তানে ৯ বছর। নেপাল অভ্যুত্থান পরবর্তী সাড়ে ৭ বছরেও সংবিধান তৈরি করতে পারেনি। আমেরিকার সংবিধান প্রণয়নে লেগেছে ১৩ বছর। ব্যতিক্রম শুধু আমরা, মাত্র ১ বছরের মধ্যে সংবিধান রচনা করেছি। এই সংবিধান নিয়ে নানা কথাবার্তা থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন সংবিধান করতে আমাদের কত বছর সময় লাগবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদের লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর তা পূরণে সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তর এবং চব্বিশকে ধারণ করা বাংলাদেশপন্থি রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য চেয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চান এই আন্দোলনের নায়করা। তারা আরও বলেন, এর মাধ্যমে গড়ে উঠবে কাক্সিক্ষত প্রজাতন্ত্র। যেখানে সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। পরিবারতন্ত্র নয়, মেধা এবং যোগ্যতায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে।
তাদের নীতিগত অবস্থানের বিষয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষমতায় কে যাবে, তা ভারত নির্ধারণ করবে না। ভারতপন্থি, পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুক্রবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জনারণ্যে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাদের ঘোষণাপত্রে এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। উপদেষ্টার পদ ছেড়ে নবগঠিত এই দলটির দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ ইসলাম ঘোষণাপত্র সবার সামনে তুলে ধরেন।
ড. শাহদিন মালিক আরও বলেন, আমাদের এখানে অনেক রাজনৈতিক দল বিদ্যমান। সংবিধান প্রণয়নে ‘ক’ দল একরকম মতামত দেবে। ‘খ’ দল আরেক রকম মতামত দেবে। ‘গ’ দল আরেক রকম মতামত দেবে। ‘ঘ’ দল একরকম মতামত দেবে। এসব মতামত সমন্বয় করে কিংবা সবার মতামত আমলে নিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নে কত বছর প্রয়োজন হবে, এটা কারও জানা নেই। কেউ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলতেও পারবেন না। যদি নতুন সংবিধান প্রণয়নে ৪ বা ৫ বছর প্রয়োজন হয়। কিংবা আরও বেশি সময়ের দরকার হয়-তাহলে দেশ এই সময় পর্যন্ত কি অনির্বাচিত সরকার চালাবে। প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নই বা কারা করবে। বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার। এজন্য প্রয়োজন প্রস্তাবগুলোর ব্যবহারিক দিকগুলোও খতিয়ে দেখা।
সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার পতন ঘটানো ইতিহাসের মেরুকরণ পালটে দেওয়া ছাত্র নেতৃত্বের এই দাবির ব্যবহারিক দিক নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গণআন্দোলন কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের পর পৃথিবীর অনেক দেশেই সংবিধান সংশোধন হয়েছে। আন্দোলনের মূল চাওয়া ধারণ করা হয়েছে। তবে সেকেন্ড রিপাবলিক তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকতে হবে। নতুন সংবিধান প্রণয়নে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তারা বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সংবিধান প্রণয়নে অনেক সময় লেগেছে। আমাদের এখানে সংবিধান প্রণয়নে কত দিন লাগবে, তা কারও জানা নেই। সংবিধান প্রণয়নে যদি ৪ বা ৫ বছর সময় লাগে তাহলে এতদিন কি দেশ অনির্বাচিতরা চালাবে-এমন প্রশ্ন রাখেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা জামান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ছাত্ররা যে দাবি জানিয়েছে তা যৌক্তিক। গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেক দেশে সংবিধান সংশোধন হয়েছে। গণআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করা হয়েছে।
যেমন ফ্রান্সে এখন পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়েছিল একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সংবিধান প্রণয়নের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতার পর আমরা যে সংবিধান পেয়েছি তা জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেনি। আমরা আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে পারিনি বাহাত্তরের সংবিধানের কারণে। আজ যে এত হানাহানি-মারামারি-কাটাকাটি-অনিয়ম-অব্যবস্থা-বৈষম্য-এসবের মূলে কিন্তু এই সংবিধান। তাই ৫ আগস্টের পর আন্দোলনে জয়ী ছাত্ররা নতুন সংবিধান প্রণয়ন, সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চাইতেই পারে। এমনকি তাদের সেকেন্ড রিপাবলিক তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার দাবিটিও অযৌক্তিক নয়। তবে তাদের এই দাবি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নির্ভর করছে দেশের জনগণ কি বলেন, কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো কি বলে তার ওপর।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল শনিবার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, নতুন দলের উদ্যোক্তাদের মাথায় সেকেন্ড রিপাবলিক তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ধারণাটা হয়তো ফ্রান্সের ঘটনা প্রবাহ থেকে এসে থাকতে পারে। তবে ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের এখানকার বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যেমন নতুন সংবিধান রচনাসহ পুরো শাসন ব্যবস্থা নিজেদের মতো করে সাজিয়েছি। সেটা হয়তো ছাত্রদের ভাষায় প্রথম রিপাবলিক বা প্রথম প্রজাতন্ত্র। এটা ধরে নিয়েই ৫ আগস্টের পর তারা নতুন করে সংবিধান রচনাসহ পুরো শাসনা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে চান। আর এই চাওয়াটারই নাম দিয়েছেন সেকেন্ড রিপাবলিক তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তবে এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করতে হবে তাদের। শুধু তাই নয়, এই চাওয়া পূরণে নির্বাচনে যেতে হবে। জনগণ তাদের ভোট দিলে, জনগণের ম্যান্ডেট থাকলে, তারা তখন যা খুশি করতে পারবেন।