Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন ‘উত্তরা গণভবন’

Icon

মো. শহীদুল হক সরকার, নাটোর

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন। প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অপরূপ নিদর্শন এটি। ঐতিহ্যের জৌলস, অতীতের রাজ-রাজন্যের স্মৃতি, প্রাচীনত্ব আর ইতিহাসের সোনালি দিনগুলোকে বুকে ধারণ করে নীরব সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা। ভবনটির সামনে এলে সবাইকে থমকে যেতে হয়। দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহ দুয়ার। এর ওপরে অতিকায় এক ঘড়ি-যা ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে আজও সঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ও পরিখার বেষ্টনী। দেশি-বিদেশি দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষরাজি। ইটালিয়ান গার্ডেনে শোভা পাচ্ছে শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য।

জানা যায়, দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি আঠারো শতকে নির্মিত দিঘাপতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। এটি নাটোর শহর থেকে প্রায় ২.৪ কিমি. দূরে। ১৯৭২ সালে দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন নামকরণ করেন। ঢাকার বাইরের এই একটি মাত্র স্থাপনায় আগে মন্ত্রিসভার বৈঠক হলেও এখন আর হয় না। সর্বশেষ খালেদা জিয়ার শাসনামলের শেষদিকে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছিল। সংরক্ষিত এই উত্তরা গণভবনের রাজপ্রাসাদ ও ইটালিয়ান গার্ডেন অংশটুকু বাদে বাকি সব স্থাপনা ও চত্বর ২০০৯ সাল থেকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে চালু করা হয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা ও সংগ্রহশালা। রোববার ছাড়া প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। মূল ফটকে প্রবেশমূল্য সিনিয়র সিটিজেন ১০ টাকা, শিক্ষার্থী এবং দলগত জনপ্রতি ২০ টাকা, সাধারণ ৩০ টাকা, বিদেশি নাগরিক ৬০০ টাকা আর সংগ্রহশালায় প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা। সে সময়ের রাজা জমিদার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও রাজকন্যার লেখা প্রদর্শন করা হয় এই সংগ্রহশালায়। বছরজুড়ে এখানে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে। প্রতিদিন গড়ে এক হাজার দর্শনার্থী আসেন এই স্থাপনা পরিদর্শনে। তবে শীতে পিকনিকের মৌসুমে এবং দুই ঈদে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায় অনেকগুণ। উত্তরা গণভবনের হিসাব সহকারী নুর মোহাম্মদ জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে টিকিট বিক্রি এবং গাড়ি পার্কিং খাত থেকে তাদের আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা।

রাজপ্রাসাদ নির্মাণ : দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাটোরের রাজা রামজীবন ও রানি ভবানীর বিশ্বস্ত চৌকশ দেওয়ান দয়ারাম রায়। ১৭০৬ সালে রামজীবনের কাছ থেকে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় জমিদারি লাভ করেন। এরপর দুইশ বছরের অধিক সময় ধরে বগুড়া, পাবনা, জামালপুর ও যশোর জেলার অংশবিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে শাসন করেছে এই রাজবংশ। ১৭৩৪ সালে প্রায় ৪৩ একর জমির ওপর দিঘাপতিয়া প্রাসাদের মূল অংশ ও এর সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেন। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে যোগ দেন। কিন্তু অধিবেশনের শেষদিন ১২ জুন প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পরে ১৮৯৭ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের চেষ্টায় বিদেশি প্রকৌশলী চিত্রকর্ম শিল্পীদের সহায়তায় ৪১.৫০ একর জমির ওপর প্রমদানাথ রায় মোগল ও প্রাশ্চাত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক কারুকার্যখচিত রাজপ্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করেন। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন।

মূল রাজপ্রাসাদে যা আছে : দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এর মাঝে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলরুম। শীর্ষে রয়েছে বিশাল এক গম্বুজ। এর নিচ দিয়ে হলরুমে সূর্যের আলো ঢোকে। হলরুমের মাঝে রাজার আমলে তৈরি বেশকিছু সোফা রয়েছে। এছাড়া হলরুমে একটি ব্যতিক্রমী কারুকার্যখচিত সোফা রয়েছে যাতে একসঙ্গে চারজন চারমুখী হয়ে বসা যায়। ওপরে রয়েছে সেই আমলের ঝাড়বাতি। হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নাঘর হতে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডরের দুপাশে রাজ আমলের তার দিয়ে এখনো ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পাশের ঘরটি রাজার শয়ন ঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাট শোভা পাচ্ছে।

আরও যা দেখার আছে : কুমার প্যালেসের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। দক্ষিণে রানিমহল। আজ আর সেটা নেই। রানিমহলের সামনে একটি ফোয়ারা এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল। নাটোরের জেলা প্রশাসন আবার নতুন করে সেই চিড়িয়াখানা চালু করেছে, রাজার ট্রেজারি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সংগ্রহশালা। রাজা-রানির ব্যবহৃত নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দর্শনার্থীদের দেখার জন্য এই সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। মূল ভবন রাজপ্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আবক্ষমূর্তি। এর দুপাশে রয়েছে দুটি কামান। রাজপ্রাসাদের সামনে পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চার চাকাবিশিষ্ট একটি কালো কামান। সংগ্রহশালার প্রবেশ করিডরে রয়েছে ধাতববর্ম। এটা পড়েই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে পিতলের তৈরি এ বর্মটি দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে।

দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান : রাজপ্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইটালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশি-বিদেশি নানাজাতের ফুলে পরিপূর্ণ এ বাগান। বাগানের ভেতর শ্বেতপাথরের আকর্ষণীয় ৪টি নারীর ভাস্কর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। রয়েছে একটি ইটালিয়ান ঐতিহ্যের ফোয়ারা এবং লৌহ ও কাঠ দ্বারা নির্মিত বেঞ্চ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, একটি ডিম্বাকার সাইজের মার্বেল পাথরের নির্মিত আসনসহ মঞ্চ। সমগ্র বাগানে অসংখ্য ফুলের সমাহার। আছে পারিজাত, নাগালিঙ্গম, কর্পূর, এগপ্লান্ট, হৈমন্তীর মতো দুষ্প্রাপ্য সব বৃক্ষরাজি আর কৃত্রিম ঝরনা। গণভবনে প্রবেশের পরই যে সুবিশাল মাঠটি রয়েছে সেটিও এখন মেতেছে আগুনঝরা ফাগুনে। গণভবনজুড়েই এখন পাখির কলতান। নাটোরের জেলা প্রশাসক এবং উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আসমা শাহীন বলেন, লেকের পানি এবং মৎস্য ব্যবস্থাপনাসহ ঐতিহ্য-স্থাপত্যের উত্তরা গণভবনের সব সংস্কার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনায় হওয়া উচিত। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই মাস্টারপ্ল্যানের অধীনে এই ঐতিহ্যকে সুরক্ষা প্রদান করা হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম