Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

সমন্বিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র সংকট

ক্যানসার চিকিৎসায় পিছিয়ে দেশ

জনসংখ্যাভিত্তিক রোগী নিবন্ধন কার্যক্রম নেই * ৮ বিভাগে ক্যানসার সেন্টার তৈরিতে ধীরগতি * ওষুধে আগালেও বিশেষজ্ঞ তৈরি ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্যানসার দীর্ঘস্থায়ী রোগ। চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক। যতটুকু সেবার ব্যবস্থা আছে, তাও রাজধানীকেন্দ্রিক। আস্থা রেখে সেবা নেওয়া যায় দেশে-এমন সমন্বিত চিকিৎসাকেন্দ্র (এক ছাদের নিচে ক্যানসারের সব চিকিৎসা) এখনো গড়ে ওঠেনি। বিত্তবান রোগীদের বড় একটি অংশ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যায়। যারা খরচ জোগাতে পারেন না, তাদের বেশির ভাগই মাঝপথে চিকিৎসা নেওয়া ছেড়ে দেন। অনেকে মারা যান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্যানসারের ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। তবে প্রয়োজনীতা অনুসারে সমন্বিত চিকিৎসাকেন্দ্র ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তীব্র সংকট রয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপ্রতুলতায় অনেক ক্ষেত্রে নির্ভুল রোগ নির্ণয় হচ্ছে না। ফলে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ক্যানসারের চিকিৎসায় পিছিয়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, পরিবেশদূষণসহ নানা কারণে ক্যানসার বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষ কমপক্ষে ৩২ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশে প্রধান পাঁচটি ক্যানসারের মধ্যে আছে খাদ্যনালি, ঠোঁট ও মুখ, ফুসফুস, স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসার। পুরুষের ক্ষেত্রে খাদ্যনালির আর নারীদের স্তন ক্যানসার বেশি। মৃত্যু বেশি হচ্ছে খাদ্যনালির ক্যানসারে।

ক্যানসার চিকিৎসা একক কোনো চিকিৎসকের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করতে হয়। জেলা-উপজেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণ ও সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। রেফারেল সিস্টেমে ঘাটতি থাকায় বেশির ভাগ রোগী তৃতীয় বা চতুর্থ স্টেজে (পর্যায়) সঠিক চিকিৎসকের কাছে আসছেন। এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে শয্যা ও যন্ত্রপাতি সংকটে চিকিৎসা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। নিরুপায় হয়ে বেসরকারিতে গেলেও ৯০ ভাগ রোগীর পক্ষে উচ্চমূল্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। ততদিনে ক্যানসার নিরাময় কঠিন হয়ে পড়ে।

মঙ্গলবার রাত ১১টা। মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সি ও ডি ব্লকের মাঝের রাস্তা থেকে কয়েক গজ দূরে মাদুর পেতে অন্তত ৫০ জনকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। পাশ দিয়ে ধুলা-ধূসরিত করে তীব্র শব্দে ছুটে চলছে বিভিন্ন যানবাহন। শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে মশার উৎপাত সহ্য করে অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে এসেছেন। কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে শয্যা সংকট থাকায় কেউ ভার্তির জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ কেমোথেরাপির তারিখ পেতে, কেউবা এসেছেন রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করাতে।

সড়ক থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে পাতা বিছানায় মা-বাবার সঙ্গে শুয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সোনিয়া আক্তার (২৫)। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বছরখানেক আগে শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। ঢাকা মেডিকেলে গেলে চিকিৎসকরা ৮টি কেমোথেরাপি লেখেন। রিকশাচালক স্বামীর চিকিৎসা খরচ জোগাতে না পারায় দুটি থেরাপি নিয়ে বাড়ি চলে যান। মাসকয়েক পর অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাবা আব্দুর রহিম ৪ শতাংশ বাড়ির ৩ শতাংশ বিক্রি করে এখানে নিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে চারটি কেমো নেয়েছেন। ৫নং থেরাপির তারিখ পেতে অপেক্ষা করছেন। কাল-পরশু সিরিয়াল নম্বর পেলেও কেমো পেতে হলে অন্তত এক মাস পর আসতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন কার্যক্রম নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবকোন’ প্রতিবেশী ভারতের চিত্র দেখে বাংলাদেশে রোগীদের একটি অনুমিত তথ্য দিচ্ছে। এতে প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। গ্লোবকোনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ। এর সঙ্গে প্রতিবছর দেড় লাখ নতুন যোগ হয়। বছরে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার রোগী মারা যান। কনসালটেন্ট ফিজিশিয়ান মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগ নির্ণয়, সার্জারি এবং নানা ধরনের থেরাপি। দেশে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব রয়েছে। অনকোলজি চিকিৎসকরা তুলনামূলক পিছিয়ে রয়েছেন। ক্যানসার চিকিৎসায় বায়োপসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা জরুরি। দেশে থেরাপির ওষুধ অনেকগুলো উৎপাদন হলেও পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় দাম বেশি। দেশে বর্তমানে ১৭৫ থেকে ২০০টি রেডিওথেরাপি মেশিন দরকার। আছে মাত্র ২০টির মতো। মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যানসারে সমন্বিত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। যার প্রধান উপাদান রেডিওথেরাপি মেশিন। অন্যান্য চিকিৎসা যেমন: কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি লাগতে পারে। রোগীর চাপে সরকারিতে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়।

পারসোনালাইজ থেরাপির জন্য মলিকুলার ল্যাব নেই। সেবাদানে চিকিৎসক থাকলেও তাদের কাজের সুযোগ কম। উন্নত দেশের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিভাগীয় হাসপাতালগুলোয় যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সুপারনিউমারারি পদে পদায়ন জরুরি। তাতে রোগীদের ঢাকা ও বিদেশমুখিতা কমবে। সময় ও অর্থ বাঁচবে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, আর্থসামাজিক বিচেনায় দেখা যায়, অধিকাংশ ক্যানসার রোগী দরিদ্র, নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা পরিকল্পনা ও খরচ জোগাতে বেশির ভাগ রোগী ব্যর্থ হন। জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে কেমোথেরাপির অনেক ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হলেও রোগীর সংখ্যাধিক্যের চাপে সবাই পান না। সরকারিভাবে ওষুধের সরবরাহ বাড়ানো দরকার। মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে ৬টি রেডিওথেরাপি মেশিনের সবই অকেজো। অন্তত ৮টি বিভাগে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। মেডিকেল কলেজগুলোয় রেডিয়েশন সেন্টার দরকার। পেট সিটি ও এনজিএস পরীক্ষার ব্যয় কমাতে হবে। বেসরকারিভাবে নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা, নতুন মলিকুল তৈরি এবং ওষুধের মান ঠিক রেখে দাম কমাতে হবে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু দেশে অপ্রতুল চিকিৎসা, অবকাঠামো ও সুযোগের অভাব রয়েছে। মেডিকেল শিক্ষার কোর্স কারিকুলামে (এমবিবিএস) ক্যানসার নিয়ে পড়ানো হয় না। অনেক সময় ব্যক্তিগত গবেষণায় সমর্থন পাওয়া যায় না। গবেষণার মাধ্যমে স্বাস্থ্যনীতি করা দরকার, সেটি হচ্ছে না। এজন্য গবেষণা তহবিল গঠন, বেসরকারি খাতকে তহবিলে অন্তর্ভুক্তি, তরুণদের গবেষণায় উৎসাহদান, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য পুরস্কৃত করা জরুরি। না হলে বিদেশে রোগী যাওয়া বন্ধ হবে না।

ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি করা দেশের চিত্র : ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি করছে-এমন কয়েকটি দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে একাধিক চিকিৎসক এবং সেখানে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সঙ্গে কথা বলেছে যুগান্তর। তারা জানিয়েছেন, ক্যানসার চিকিৎসায় থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হাসপাতাল রয়েছে। প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরা রোবোটিক সার্জারি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, প্রোটন থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করছেন। থাই হাসপাতালগুলো স্টেম সেল থেরাপির পাশাপাশি হোলিস্টিক ক্যানসার কেয়ার হিসাবে আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে ঐতিহ্যগত ওষুধ প্রয়োগেও সেবা দিয়ে থাকে।

ভারতের অনেক হাসপাতালে প্রোস্টেট ক্যানসার সার্জারি, স্তন ক্যানসার সার্জারি এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসার সার্জারির মতো জটিল পদ্ধতির জন্য রোবোটিক সার্জারি সুবিধা রয়েছে। রেডিয়েশন থেরাপির ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক, চোখ বা মেরুদণ্ডের মতো সংবেদনশীল অংশের কাছাকাছি টিউমারের চিকিৎসায় প্রোটন থেরাপি সেবা দিয়ে থাকে। মেলানোমা, ফুসফুসের ক্যানসার এবং লিউকেমিয়ার মতো ক্যানসারের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে ইমিউনোথেরাপি দেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরের হাসপাতালগুলোয় ক্যানসার জিনোমিক্স চিকিৎসকরা রোগীদের জন্য ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিকল্পনা ডিজাইন করতে সাহায্য করে থাকে। জটিল ক্যানসার সার্জারির জন্য রোবোটিক সার্জারির ব্যবহার সূক্ষ্মতা এবং দ্রুততার সঙ্গে সেবা দিয়ে থাকেন। জাপান ক্যানসারের সেবাদানে আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির সঙ্গে ঐতিহ্যগত ওষুধের সমন্বয়ের জন্য পরিচিত। দেশটি প্রাথমিক ক্যানসার শনাক্তে এগিয়ে গেছে। এছাড়া দেশটি রুটিন স্ক্রিনিং এবং উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাথমিক শনাক্তকরণে এগিয়ে রয়েছে। জার্মানির হাসপাতালগুলো যথার্থ ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রিসিশন মেডিসিন ক্যানসার, পেডিয়াট্রিক ক্যানসার এবং টিউমারের রোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি করেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম