Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

যুগান্তর-ইনসেপ্টা গোলটেবিল

ক্যানসার চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ

প্রতি বছর দেড় লাখ নতুন রোগী, ১ লাখ ১৭ হাজার মারা

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্যানসার চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ

চ্যানেল আই ভবনে রোববার মেডিকেল অনকল সোসাইটি আয়োজিত বিশ্ব ক্যানসার দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তৃতা করছেন মেজর জেনারেল ডা. মো. আজিজুল ইসলাম (পিআরএল) -যুগান্তর

অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে দেশের মানুষের মধ্যে ক্যানসার অনেক বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষ কমপক্ষে ৩২ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ক্যানসার দীর্ঘস্থায়ী রোগ। চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। তা ছাড়া রোগটির চিকিৎসা রাজধানীকেন্দ্রিক। আস্থা রেখে ক্যানসার চিকিৎসা করা যায়, এমন প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে গড়ে ওঠেনি। এমন প্রেক্ষিতে ক্যানসার চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব ক্যানসার দিবস-২০২৫ উপলক্ষ্যে রোববার রাজধানীর চ্যানেল আই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ তাগিদ দেন। ‘ক্যানসার জয় আমরাই পারি’ প্রতিপাদ্য বৈঠকটির আয়োজন করে দৈনিক যুগান্তর ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বৈঠক সঞ্চালনা করেন। বৈঠকে আলোচক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীর, রেডিয়েশন অনকোলজির বিভাগীয় প্রধান ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ, মেডিকেল অনকোলজির বিভাগীয় প্রধান ডা. নাজরীনা খাতুন, ডা. মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান বিদ্যুৎ, মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও গবেষণা সহকারী ডা. এটিএম কামরুল হাসান।

বৈঠকে আরও অংশ নেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজির বিভাগীয় প্রধান ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম, মেডিকেল সার্ভিসেস বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস (ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট)-এর ডাইরেক্টরেট জেনারেল ডা. মো. আজিজুল ইসলাম, আহসানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতালের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসর) মো. কুদরত-ই-ইলাহী, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডা. ফেরদৌস আরা বেগম। 

আরও অংশ নেন মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. পারভীন শাহিদা আখতার, সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম, গাইনি অনকোলজিক্যাল সোসাইটি ইন বাংলাদেশ’র সভাপতি অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ডা. মো. শাহরিয়ার কবির, ডা. নাজমা আজীম, ডা. নাহিদ হোসেন, ডা. রাশিদুল ইসলাম রাসেল, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটিডের নির্বাহী পরিচালক আশরাফ উদ্দীন আহমেদ প্রমুখ।

বৈঠকে ডা. এটিএম কামরুল হাসান বলেন, দেশে ১৫ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেন। প্রতি বছর দেড় লাখ নতুন রোগী যোগ হয়। প্রায় এক লাখ ১৭ হাজার রোগী বছরে মারা যান। এদেশে মূলত জরায়ু, খাদ্যনালী, স্তন এবং ও মুখগহ্বরের ক্যানসার বেশি হচ্ছে। এক্ষেত্রে সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে রোগীর মৃত্যু হয়। আমাদের উচিত উন্নত দেশের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি কাজে লাগানো। 

ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন ক্যানসার রোগীরা। পার্শ্ববর্তী দেশের ভিসা বন্ধ থাকায় রোগীরা সেখানে যেতে পারছেন না। ফলে দেশে চাপ বেশ বেড়েছে। 

ডা. মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব রয়েছে। দেশে থেরাপির ওষুধ অনেকগুলো উৎপাদন হলেও পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় দাম বেশি। দেশে বর্তমানে ১৭৫ থেকে ২০০টি রেডিওথেরাপি মেশিন দরকার। অথচ এখন আছে মাত্র ১০-২০টি। একটি মেশিন বসাতে ১০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। এদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। কিন্তু রেডিওথেরাপি মেশিন বসাতেই যত সমস্যা। আমাদের কমপ্রিহেনসিভ ক্যানসার সেন্টার দরকার। মাত্র ১/২টি সেন্টার এখন আছে। 

ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান বলেন, মানবদেহে ক্যানসার তৈরি করে এমন রিস্ক ফ্যাক্টর কমানো এবং প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা দরকার। এতে রোগী কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অ্যালকোহল, ধূমপান, কম শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদির কারণে ক্যানসার হওয়ার শঙ্কা বেশি। এছাড়া সবজি, ফলমূল বেশি খাওয়া দরকার। দেশে মাছে এবং ফলমূলে ফরমালিন এবং ট্যানারি বর্জ্যরে পোলট্র্রি খাদ্যের কারণে ক্যানসার সৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বায়ূদূষণও একটি বড় সমস্য। তবে স্তন ক্যানসার স্কিনিং, হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন, জরায়ুমুখের ক্যানসারবিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান ও ধূমপান পরিহারে প্রতিরোধ করা যায়। 

ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু অপ্রতুল চিকিৎসা, অবকাঠামো ও সুযোগের অভাব রয়েছে। অনেক সময় ব্যক্তিগত গবেষণার সমর্থন পাওয়া যায় না। এজন্য গবেষণার মাধ্যমে স্বাস্থ্যনীতি করা দরকার। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

ডা. মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান বিদ্যুৎ বলেন, ক্যানসার চিকিৎসা একক কোনো চিকিৎসকের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মালটি ডিসিপ্লিনারি কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দেশে রেফারেল সিস্টেমে ঘাটতি আছে। ফলে ক্যানসার নিরাময় কঠিন হয়ে পড়ে। মেডিকেল শিক্ষার কোর্স কারিকুলামে ক্যানসার চিকিৎসার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

ডা. ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় পেট সিটি স্ক্যান দরকার হয়। শুধু ঢাকায় সরকারি তিনটি হাসপাতালে এই মেশিন আছে। আর কোথাও নেই। আমরা যদি পেট সিটি স্ক্যান বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে স্থাপন করতে পারি তাহলে রোগ নির্ণয় সহজ হবে। এছাড়া দেশে অনকোলজিক্যাল রেডিওলজিস্ট প্রয়োজন। 

ব্রি. জেনারেল মো. কুদরত-ই-ইলাহী (পিআরএল) বলেন, রোগীরা যে বিদেশে যাচ্ছেন এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমাদের দেশেই বিদেশি অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। 

ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ ও যন্ত্রপাতি দেশে পাওয়া যাচ্ছে। ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। ১৯০ দেশে ওষুধ রপ্তানিও করা হচ্ছে। তাহলে রোগী কেন বিদেশে যান। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ব্যবহারগত আচরণ ভালো করতে হবে। আস্থার সংকট দূর করতে হবে। 

অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের অন্তত ৮টি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে রেডিয়েশন সেন্টার স্থাপন জরুরি। 

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, দেশব্যাপী জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন কার্যক্রম নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবকোন পার্শ্ববর্তী দেশের রোগীর চিত্র দেখে বাংলাদেশে একটি অনুমিত তথ্য দিচ্ছে। জনসংখ্যাভিত্তিক নিবন্ধন চালু না হওয়ায় প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধমূলক কাজেও তেমন বাজেট ও অর্থায়ন নেই। 

চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক ডা. নাজরীনা খাতুন। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্যানসার রোগী দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। খরচ জোগাতে বেশির ভাগ ব্যর্থ হন। জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে কেমোথেরাপির অনেক ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হলেও রোগীর সংখ্যাধিক্যের চাপে সবাইকে সরবরাহ করা যায় না। বেসরকারিভাবে ব্যয় কমাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ব্যয় কমানো, নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা, কোম্পানিগুলোকে নতুন মলিকুল তৈরি ও ওষুধের মান ঠিক রেখে দাম কমানোর আহ্বান জানাই।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম