রাজশাহী সিটি করপোরেশন
সড়ক সংস্কারে নিম্নমানের কাজ, বিপুল অর্থ নয়ছয়
দুই-তিন মাসেই উঠে যাচ্ছে কার্পেটিং স্থানে স্থানে গর্ত
রাজশাহী মহানগরীর ভদ্রা রেল গেট থেকে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ৪ দশমিক ১৭ কিলোমিটার চারলেনের সড়ক সংস্কারে ব্যয় হয় ৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ২০২১ সালের ৬ নভেম্বর ৮০ ফুট প্রশস্ত এই সড়কটির কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর সড়কটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। দেড় বছরের মধ্যে নতুন এই সড়কটির ২০টি স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। উঠে যাচ্ছে বিটুমিন ও কার্পেটিং। সড়কটি নির্মাণের সময় এলাকার বাসিন্দারা অতি নিম্নমানের কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে ঠিকাদার কাউকে তোয়াক্কা করেননি। এভাবে রাজশাহী নগরীর সড়কগুলো সংস্কার ও উন্নয়নে কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করা হলেও সেগুলো এক-দেড় বছরের মধ্যে নষ্ট হওয়ার পথে।
রাজশাহী মহানগরীতে সড়ক উন্নয়নে ব্যাপক অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগরীর সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নগরজুড়ে সড়ক ও ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন করা হচ্ছে। এই মেগা প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুনে ১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকার মধ্যে ৫৪০ কোটি টাকার সাতটি বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে চলমান চারটি ফ্লাইওভার সাব-প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৬১৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ও গলি সড়ক এবং ড্রেন উন্নয়ন করা হচ্ছে। রাসিক সূত্রে জানা গেছে, তালাইমারী মোড় থেকে কাটাখালী পর্যন্ত ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার ছয় লেন সড়কটি বিশ্বমানের সড়ক করার কথা প্রকল্প পরিকল্পনায় রয়েছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, যানজট নিরসন ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নগরীর তালাইমারী-কাটাখালী সড়কটিতে কোনো বাঁক রাখা হবে না। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে এখনো কাজ চলছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিপুল ব্যয়ের এই সড়কটির কাজ যেনতেনভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ছয় লেনের সড়কটিতে ২ মিটার প্রশস্ত সড়ক বিভাজক থাকার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও বিভাজক করা হয়েছে এক মিটার, কোথাও একটু বেশি। সড়কের দুই ধারে ৩ মিটার করে অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক লেনসহ চওড়া ফুটপাত ও ৩ মিটার চওড়া ড্রেন তৈরির কথা বলা হলেও সব খানে তা হয়নি। বিশ্বমানের বলা হলেও সড়কের কার্পেটিং ও ফিনিশিং নিম্নমানের। কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্পেটিং উঠে যেতে শুরু করেছে।
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির কাজের দায়িত্বে রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজার কুমারেশ দাস বলেন, প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা কাজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজশাহী সিটি করপোরেশন জায়গা বুঝিয়ে দিতে পারেনি। সড়কটি পরিকল্পনামতো করতে গেলে তালাইমারী থেকে কাটাখালী পর্যন্ত ১২টি স্থানে কিছু কিছু পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু করপোরেশন তা করতে পারেনি। ফলে আমরা যেভাবে পেরেছি কাজটি শেষ করার চেষ্টা করেছি। কোনো উপায় ছিল না।
সরেজমিন দেখা গেছে, কাটাখালীর মাসকাটাদিঘি এলাকায় সড়কটি প্রায় ৩৫০ মিটারের মতো বাঁকা হয়ে গেছে। তালাইমারী মোড় এলাকায় সড়কটি আগের মতোই সরু থেকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটকের সামনেও প্রশস্ত হয়নি। কাজলা গেটের সামনে সড়কটি থেকে গেছে আগের মতোই। এলাকাবাসী বলছেন, আলোচিত সড়কটি যেনতেনভাবে করে বাজেটের একটা বড় অংশ তছরুপ করা হয়েছে।
এদিকে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে গলি ও ছোট সড়ক সংস্কার ও ড্রেন নির্মাণের কাজ সম্প্রতি শেষ হলেও সড়কগুলো ভেঙে যেতে শুরু করেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, সাবেক মেয়রের আমলে বিভিন্ন ছোট ছোট প্যাকেজ করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এসব কাজের পুরোটাই ভাগাভাগি করে নিতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। কাউন্সিলরদের মধ্যে ২১নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নিযাম উল আজীম ছোট কাজগুলো ভাগাভাগির নেতৃত্বে ছিলেন। নিযাম ছিলেন সাবেক মেয়রের আত্মীয়। এই সুবাদে সব কাজই তার হাত দিয়ে যেত। নিযাম প্রতিটি প্যাকেজ বিক্রি করতেন ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কমিশন নিয়ে। এসব কাজে গুরুতর অনিয়ম হলেও রাসিকের প্রকৌশল বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রাসিকের দুর্নীতির হোতা সাবেক কাউন্সিলর নিযাম একাধিক মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
রাজশাহী মহানগরীর শিরোইল এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন তালুকদার বলেন, গলি সড়ক ও ড্রেনগুলো এমন দায়সারাভাবে করা হয়েছে যেগুলো নির্মাণ শেষের আগেই নষ্ট হতে শুরু করেছে। নগরীর আলিফ লাম মীম ভাটা মোড় থেকে চৌদ্দপাই পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার চারলেন সড়কটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ২০২১ সালের জুনে। ইতোমধ্যে এই সড়কটির বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। দেবে গেছে সড়কের ৩০টির বেশি স্থান।
নগরীর বিলসিমলা এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়া সড়কটি মাত্র দুই মাস আগে নির্মাণ শেষ করেছেন ঠিকাদার। নির্মাণের সময় সড়কে যেসব খোয়া ও উপকরণ দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই ছিল পুরোনো বাড়ি বা সড়কের ভাঙা খোয়া। সাব-বেইজ করার সময় এক ইঞ্চির কম পাথর বিছানো হয়। বিটুমিন দেওয়া হয় নামমাত্র। ফলে দুই মাসেই সড়কটি ভেঙে গেছে। সাইফুল ইসলাম বলেন, নির্মাণের সময় অতি নিম্নমানের কাজ দেখে আমরা রাসিকের প্রকৌশল শাখায় অভিযোগে করেছিলাম। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি।
জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আহমেদ আল মইন বলেন, এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় অনেক সড়কে ক্ষত হয়েছে। এটাকে আমরা নিম্নমানের কাজ বলছি না। দ্রুত সড়কগুলোর এসব ক্ষত সারিয়ে দেওয়া হবে।