পাণ্ডুলিপি ও দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়নি
নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানো শুরু হয়নি
দেড় মাসের মধ্যে ছাপাতে হবে ৪০ কোটির বেশি বই
দেড় মাস পরেই শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ। অথচ এখনো শুরু হয়নি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের ছাপানোর কাজ। শেষ হয়নি সব শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও দরপত্র প্রক্রিয়া। দরপত্র অনুযায়ী মুদ্রণকারীদের এসব বই ছাপার জন্য ৫০ দিন সময় দিতে হবে। এবার স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপানোর কথা রয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক শ্রেণিতে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের গ্রাফিতি (দেওয়ালচিত্র) যুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অবদানকেও নতুনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে বাদ পড়ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত উক্তি। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এখনো সব বই ছাপানো চুক্তি শেষ করতে পারেনি। এখনো চলছে সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ।
মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের মতো দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে বছরের শুরুতে কিছু বই পৌঁছানো সম্ভব হলেও সব বই ছাপা শেষ হতে মার্চ পর্যন্ত সময় লাগবে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে নতুন বই ছাপিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই বই দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত জুন মাস থেকেই নতুন বর্ষের বই তৈরি কার্যক্রম শুরু হয়। এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে তিন মাস দেরিতে শুরু এই কার্যক্রম। সামনে যে সময় আছে, এর মধ্যে ৪০ কোটির বেশি পাঠ্যবই ছাপানোর সক্ষমতা দেশের মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের নেই। এ ছাড়া এই সময়ে চাহিদামতো মানের এত কাগজ পাওয়া নিয়েও সংকট হতে পারে। সম্প্রতি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বেশ কিছু বইয়ের পাণ্ডুলিপির সিডি দেওয়া হয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে। তারা এখনো বই ছাপানো শুরু করেননি। আগামী ১ জানুয়ারির আগে সব বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পৌঁছানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে তিনটি শ্রেণির বই ছাপনোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্য শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ চলছে। তবে নবম ও দশম শ্রেণির টেন্ডার (দরপত্র) প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। সেটিও দ্রুত হয়ে যাবে। বই ছাপনোর চেয়ে বাঁধাই করতে একটু সময় বেশি লাগে। যথাসময়ে এই কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। এবার প্রত্যেক শ্রেণির কিছু কিছু বইয়ের পরিমার্জন ও সংশোধন হচ্ছে। বই ছাপানোর শেষ করার বিষয়ে তিনি বলেন, কাগজের সংকট না থাকলে আমরা নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা চেষ্টা করব। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সব বই দেওয়া সম্ভব না হলেও শিক্ষার্থীদের কিছু বই দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইতোমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার জন্য প্রেসে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য শ্রেণির বইও যাবে। এবার বইয়ের কাগজের ওজন ৭০ গ্রাম থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮০ গ্রাম। আর উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৮৫ শতাংশ। বই ছাপানো ও বিতরণে খরচ হবে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা।
বিগত সরকারের আমলে এনসিটিবির কিছু অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে নিম্নমানের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপানোর কাজ দেওয়া হয়েছিল। এবারও এমন কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী বইয়ের মান ঠিক থাকবে কিনা তা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৪১ হাজার ৪৮৬টি ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫ বই ছাপানো হবে। নতুন কারিকুলামে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আগামী শিক্ষাবর্ষে কারিকুলাম পরিমার্জন ও সংশোধন হলে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা বাড়বে। এতে বইয়ের ফর্মার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে ও ছাপাতেও সময় বেশি লাগবে।
জানা যায়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ২৩ দিনের মাথায় নতুন শিক্ষাক্রম বা জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাই ২০২৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করে ২০২৬ সাল থেকে তা পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। এর আগে ২০২৫ সালে শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্বের ২০১২ সালের প্রণীত সৃজনশীল কারিকুলাম ধাঁচের পাঠ্যবই বিতরণ করা হবে। এতে পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন ও সংশোধন করে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আর নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য থাকছে বিভাগ বিভাজন। এতে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ আবার চালু হওয়ায় বাড়ছে বইয়ের সংখ্যাও।
বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান যুগান্তরকে বলেন, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য এখনো বই ছাপানো শুরু হয়নি। এখন প্রাথমিকের তিন শ্রেণির বই ছাপানোর যারা টেন্ডার পেয়েছেন, তারা যথাসময়ে বই দিতে পারবেন না। এছাড়া চার শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার এখনো শেষ হয়নি। তাই বছরের শুরুতে বই দিতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। এনসিটিবির হাতে পর্যাপ্ত সময় এখন নেই। এছাড়া কারিকুলামের যে সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ রয়েছে, তা এখনো শেষ হয়নি। তাই পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে সময় লাগছে বেশি। যেসব শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার হয়নি সেগুলোর বই ছাপানো শুরু করতে পারবে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
কিছু বইয়ের প্রচ্ছদে ও কিছু বইয়ের ভেতরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি (দেওয়ালচিত্র) যুক্ত করা হবে। যেসব বইয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ও উদ্ধৃতি রয়েছে, সেগুলো বাদ দেওয়া হবে। এর পরিবর্তে চিরন্তন কিছু বাণী যুক্ত হবে। এ ছাড়া বাংলা, ইতিহাস, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের মতো বইয়ে ইতিহাসনির্ভর বিষয়েও কিছু কাটছাঁট করা হচ্ছে।
এনসিটিবির সূত্র বলছে, আসন্ন শিক্ষাবর্ষের জন্য এবারও ৯৮টি লটে প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপানোর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে ৭০টি লটের বই ছাপানোর জন্য কার্যাদেশ পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানোর দরপত্রের মূল্যায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপানোর দরপত্র মূল্যায়ন কার্যক্রম চলছে। নবম ও দশম শ্রেণির বই ছাপানোর দরপত্র এখনো আহ্বান করা হয়নি।