যমুনার চরে আধুনিকতার ছোঁয়া
পালটে যাচ্ছে বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা
সৌরবিদ্যুতে চলছে ফ্রিজ, ফ্যান, টিভি
রফিকুল ইসলাম, গাইবান্ধা থেকে ফিরে
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
শান্তি বেগম। বয়স সত্তরের কোঠায়। জন্মের পর থেকে তিনি প্রায় ২০ বার নদীভাঙনের কবলে পড়েছেন। নদীর গ্রাসে হারিয়েছেন বাপ-দাদাসহ স্বামীর ভিটে-মাটি। এমন ভাঙা-গড়া অনিশ্চয়তার জীবনে তিনি কখনোই বিদ্যুতের স্বপ্ন দেখেননি। তবে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে তার সেই অদেখা স্বপ্নই বাস্তবায়ন হয়েছে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তিনি এখন ব্যবহার করছেন টেলিভিশন, ফ্রিজ, ফ্যান ও মোবাইল ফোন। নদীর ভাঙা-গড়া শঙ্কার মাঝেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় পালটে গেছে তার জীবন। বলছিলাম গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের চরকাবিলপুর গ্রামের বাসিন্দা শান্তি বেগমের কথা। তিনি জানান, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান। আর পড়তে চান না নদীভাঙনের কবলে। শুধু শান্তি বেগম নন, চরকাবিলপুর গ্রামে অধিকাংশ বাড়িই এখন সৌরবিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। কম্পিউটারের পাশাপাশি আধুনিক ইন্টারনেট সেবা এখন তাদের হাতের মুঠোয়। গ্রামের মধ্যেই গড়ে উঠেছে নিত্যপণ্যের বাজার। জীবন সংগ্রামে সাফল্য পেতে অনেকে শুরু করেছেন ব্যবসা-বাণিজ্য।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ যুগান্তরকে বলেন, বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে সৌরবিদ্যুতের উদ্যোগ সত্যিই অনেক ভালো। এতে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। এ সেবা আরও বৃদ্ধি করতে সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অনেক ক্ষেত্রেই চরাঞ্চলের বাসিন্দারা অনেক পিছিয়ে। এই অঞ্চলের মানুষকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। তাদের কী কী সমস্যা রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সমাধান করা হবে। এরই মধ্যেই সরকার এ বিষয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে।
চরকাবিলপুর গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক পরিকল্পনায় নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে ব্যস্ত চরের অধিকাংশ মানুষ। চরের জমিতে ধান, বাদাম ও মরিচসহ বিভিন্ন সবজি চাষে তারা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। গরু পালন করা হচ্ছে অধিকাংশ বাড়িতে। তাদের এসব কাজে সরাসরি সহযোগিতা করছে সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ফেন্ডশিপ। এই সংস্থার সাসটেইনেবল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিচাষে কৃষকদের সহায়তায় করা হচ্ছে। সেসঙ্গে সুবিধাভোগী কৃষকদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ধান, পাট, গম, ভুট্টা চাষ ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, গবাদিপশু লালন-পালন ও রোগ ব্যবস্থাপনা, গরু মোটাতাজাকরণসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে ফ্রেন্ডশিপ।
এছাড়া চরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বিনা মূল্যে কৃষিবীজ, কীটনাশক, ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির উপকরণ, গবাদিপশুর ভ্যাকসিন, গবাদিপশুর খাদ্য, কৃত্রিম প্রজননের বীজ ও কৃমিনাশক দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষি উৎপাদনের জন্য মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সঠিকভাবে সার প্রয়োগেও তারা সহযোগিতা করছেন। চরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। তবে এ ঝুঁকি কমাতে কাজ করছে ফ্রেন্ডশিপ। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তারা দেন নানা পরামর্শ।
চরবাসীদের দাবি, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহণ খরচ ও সঠিক উপায়ে চাষাবাদের পদ্ধতি না জানায় অধিক শ্রমেও পাওয়া যেত না কাঙ্ক্ষিত ফসলের ফলন। চরের কৃষক-কৃষাণিদের সংস্থাগুলো নানা পরামর্শ দেওয়ায় এখন চিত্র বদলে যাচ্ছে। চরবাসীরা শিখেছেন আধুনিক চাষাবাদ।
যমুনা নদীর গাইবান্ধা অংশে প্রায় ১৬২টি চর রয়েছে। বর্ষার মৌসুমে এসব চরে ভাঙন, ঘর-বাড়ি নদীতে বিলীন হওয়া, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। প্রতিবছর নদীভাঙনে যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এমন ভাঙা-গড়া খেলার মাঝেই আধুনিক জীবন গঠনের স্বপ্ন দেখছেন এই চরাঞ্চলের মানুষ। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত চরের নারীরা চেষ্টা করছেন নিজেদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করতে।
জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই চরগুলোকে একসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন দ্বীপ বলা হতো। এখন অনেক চরেই ইন্টারনেট সুবিধা ও বিদ্যুৎব্যবস্থা রয়েছে। সোলার বিদ্যুৎ শিক্ষাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে রাখছে ভূমিকা। ছোট-বড় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই সোলার বাতির ব্যবহার হচ্ছে। শহরনির্ভরতা কমিয়ে আনতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি গড়ে উঠছে বড় বড় হাট-বাজার। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে সব ধরনের পণ্যসামগ্রী পাওয়া যায়। ফলে চরের মানুষের শহরনির্ভরতা অনেকটাই কমে এসেছে। এমন অবস্থায় বেসরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সরকার এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন চরাঞ্চলের বাসিন্দারা।
তাদের দাবি, প্রতিবছর নদীভাঙনের শঙ্কা থাকায় চরাঞ্চলে স্থায়ীভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বেসরকারি সংস্থা যেভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখছে সরকারও সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। চরবাসিন্দা রফিক মিয়া বলেন, আমরা অনেক অবহেলিত ছিলাম। সব সময় নিজেদের অসহায় মনে হয়েছে। তবে সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন সবাই আত্মনির্ভরশীল হওয়ায় চেষ্টা করছেন। কৃষি উৎপাদনে মানুষ মনোযোগ দিয়েছে। এখন সরকার এগিয়ে এলে আমাদের জীবনে আরও পরিবর্তন আসবে। আর আমেনা খাতুন বলেন, আজ বাড়ি-ঘর আছে। কাল তা না-ও থাকতে পারে। এসব মেনে নিয়েই আমরা বসবাস করছি।