Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

মামলা-জরিমানা ডাম্পিংয়ে থোড়াই কেয়ার

ঢাকার সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা

১৯ অক্টোবর থেকে ‘ট্রাফিক পক্ষ’ * এক মাসে ২৪ হাজার মামলা, জরিমানা ৯ কোটি টাকা * বিআরটিএর সংস্কার ছাড়া সুফল আসবে না -ড. শামসুল হক

ইকবাল হাসান ফরিদ

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা

সড়কে বিশৃংখ্যলা

রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। প্রতিদিন চলছে মামলা, জরিমানা, ডাম্পিং, রেকারিং। এরপরও ফেরানো যাচ্ছে না শৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খলার কারণে সড়কে তৈরি হচ্ছে যানজট। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে যানবাহনের গতি নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে।

পরিস্থিতি উত্তরণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ১৯ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ‘ট্রাফিক পক্ষ’ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। যানজট নিরসন, নগরীর সিগন্যালিং ব্যবস্থা সক্রিয়করণসহ বেশকিছু সমস্যা নিরসনে বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সভা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত উদ্যোগ আর নির্দেশনাই দেওয়া হোক না কেন, সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে বিআরটিএতে সংস্কার করতে হবে। সংশ্লিষ্ট স্থানে বসাতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ লোক।

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ট্রাফিক পুলিশ এক সপ্তাহের বেশি সময় সড়কে ছিল না। ওই সময়ে ব্যাটারি রিকশাসহ হাজার হাজার অবৈধ যানবাহন উঠে আসে প্রধান সড়কে। ট্রাফিক পুলিশ সড়কে ফেরার পর ৯ সেপ্টেম্বর থেকে আইন প্রয়োগ শুরু করে। তবে এখনো নিয়ম ভাঙার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সড়কে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৩ হাজার ৭৯১টি। এসব মামলায় জরিমানা আদায় হয়েছে ৯ কোটি ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ১৪৫ টাকা। ডাম্পিং করা হয়েছে ২৮৬১টি গাড়ি। এই সময়ে ৬১ হাজার ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, সড়কে ব্যক্তি মালিকানার পরিবহণ বেশি চলছে। রুট পারমিট যদি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দেওয়া হয় আর উন্নত দেশগুলোর মতো কোনো পরিবহণে ত্রুটি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। বিনিয়োগ ঝুঁকির ভয়ে অন্তত কোম্পানিগুলো নিয়ম মেনে চলবে। তিনি বলেন, বিআরটিএ যেমন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়, তেমনি কোন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ছাড়া চলছে তা নজরদারি তাদের গুরুদায়িত্ব। বিআরটিএর দায়িত্বহীনতার কারণে সড়কে সমস্যা বাড়ছে। সুশৃঙ্খল, টেকসই পরিবহণ ব্যবস্থা চাইলে প্রথমেই বিআরটিএকে সংস্কার করতে হবে। যাদের ট্রান্সপোর্টেশনের জ্ঞান আছে, সেই বিজ্ঞানভিত্তিক লোকজনকে বসাতে হবে সংশ্লিষ্ট জায়গায়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সড়কে বিশৃঙ্খলা নিরসনে অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। ব্যাটারি রিকশা বন্ধে সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং পুলিশের সমন্বয়ে চার্জিং স্টেশন এবং গ্যারেজগুলোতে অভিযান চালাতে হবে। দেশীয় উৎপাদন কারখানা বন্ধ করতে হবে, বিদেশ থেকে এসব গাড়ির যন্ত্রপাতি আনা বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া পরিবহণসংশ্লিষ্টদের আইন-কানুন মানা সম্পর্কে আরও সচেতন করতে হবে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, শহরের প্রধান প্রধান ইন্টারসেকশনের ১০০ মিটার এবং অন্যান্য ইন্টারসেকশনের ৫০ মিটারের মধ্যে কোনো গাড়ি থামিয়ে রাখলে ইন্টারসেকশনের ক্যাপাসিটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়। এজন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে যেন কোনো গাড়ি না থামানো হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। সব বাস চিহ্নিত বাসস্টপে থামানোর বিষয়টি নিশ্চিতের পাশাপাশি সাধারণকেও সচেতন হতে হবে।

২০২০ সালে করা বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার। ওয়ার্কস ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সাইফুদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার এক সেমিনারে জানিয়েছেন, বর্তমানে সড়কে ঘণ্টায় যানবাহনের গড় গতি ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। যা মানুষের হাঁটার চেয়েও কম। তিনি জানান, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। অর্থমূল্যে যা দৈনিক প্রায় ১৩৯ কোটি এবং বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার অধিক।

সূত্র জানাচ্ছে, বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সড়ক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সভায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ (অব.) এর সভাপতিত্ব করেন। সভায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা, দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা এবং বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সোনারগাঁও সার্ক ফোয়ারা ইন্টারসেকশন, ফার্মগেট ইন্টারসেকশন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শেরাটন ও বাংলামোটর ইন্টারসেকশনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বুয়েটের সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

মঙ্গল ও বুধবার সরেজমিন রাজধানীর বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বাড্ডা, রামপুরা, বাংলামোটর, মগবাজার, কাকরাইল, কুড়িল বিশ্বরোডসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে দেখা গেছে, অনেক যানবাহন সিগন্যাল অমান্য করে চলাচল করছে। প্রবেশমুখগুলো বন্ধ করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিকশা ও ছোট যানবাহনগুলো। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে বাসগুলো। বিভিন্ন সড়কে বাস-ট্রাক-প্রাইভেটকার পার্ক করে রাখা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে চলছে খোঁড়াখুঁড়িও।

উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ৫৯টি যাত্রী ছাউনিসহ বাস স্টপ চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্টপেজে বাস না থেমে যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা করে। মঙ্গলবার দুপুরে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় দেখা যায়, ভিক্টর পরিবহণের দুটি বাস যাত্রী তোলার জন্য নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করছে। কুড়িলে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বলাকা পরিবহণের একটি বাসের চালককে এক হাতে মোবাইল ফোন কানে ধরে কথা বলতে এবং অন্য হাতে স্টিয়ারিং সামলিয়ে গাড়ি চালাতে দেখা গেছে। রাতে ফুলবাড়িয়া থেকে আব্দুল্লাপুরগামী বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহণের একটি বাসে চালককে চলন্ত অবস্থায় সিগারেট খেতে দেখা গেছে। একজন নারী যাত্রী সিগারেট না খেতে অনুরোধ করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি।

যাত্রবাড়ী থেকে টঙ্গী রোডে চলাচলকারী গ্রেট তুরাগ বাসের চালক আব্দুর রহমান বলেন, যাত্রী যেখানে থাকে সেখানেই আমরা বাস থামাই। ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের হেলমেট থাকলেও আরোহীর মাথায় হেলমেট নেই। অনেক মোটরসাইকেল চালক হেলমেটের ভেতরে মোবাইল ফোন গুঁজে কথা বলতে বলতে পথ চলছেন।

ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, যেখানে-সেখানে পার্কিং, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা, লেন না মেনে এলোমেলো গাড়ি চালানো, পারমিটবিহীন গাড়ি, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ব্যাটারি রিকশার দাপট, এমনকি ট্রাফিক পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। একাধিক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য যুগান্তরকে জানিয়েছেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তাদের ডিউটি করতে হচ্ছে। অনেকেই নানাভাবে সুযোগ নিয়ে নিয়ম ভাঙছে। মোড়ে মোড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আক্রমণের শিকারও হচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখন আগের মতো আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না সড়কে। পারমিট আছে কিনা, চেক করতে গেলে চালকরা নানা বাহানা করছেন। আবার বেশি কিছু বললে ট্রাফিক সদস্যদের ওপর তেড়ে আসছেন।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ১৯ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত আমরা ‘ট্রাফিক পক্ষ’ পালনের উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দ রয়েছে। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা যানজট বাড়ে। সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের এসব সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানিয়েছি। শৃঙ্খলা ফেরাতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম