হদিস নেই ‘মুজিব সেঞ্চুরি’ ওয়েবসাইটের
অ্যানিমেশন ও হলোগ্রামে লোপাট কোটি কোটি টাকা
জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এসব কোনো কাজে আসেনি-চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে। ওয়েবসাইট, অ্যাপ্লিকেশন, গেমসহ কখনো শেখ মুজিবকে নিয়ে তৈরি হয় নিম্নমানের অ্যানিমেশন সিনেমা, কখনো থ্রিডি হলগ্রাম। সরকারের অর্থ অপচয় এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সিন্ডিকেটের পকেট ভারী করাই যেন মূল উদ্দেশ্য। অভিযোগ উঠেছে, মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে নির্মিত এসব ফিল্ম, অ্যাপ্লিকেশন ও হলোগ্রামের কাজ দেওয়া হয় সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের পছন্দের কোম্পানিকে।
২০২৩ সালের ২৩ জুন মুক্তি পায় ৪৩ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘মুজিব ভাই’। ৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘মুজিব ভাই’ অ্যানিমেশনের পেছনে প্রতি মিনিটে খরচ হয়েছে সাড়ে ১১ লাখ টাকা। নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় টেকনোম্যাজিক প্রাইভেট লিমিটেডকে। সহযোগী ছিল হাইপার ট্যাগ লিমিটেড। এর গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের (এএলবিডি) ওয়েব টিমের সমন্বয়কারী তণ্ময় আহমেদ। পরিচালনা করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। নির্বাহী প্রযোজক জিনাত ফারজানা, আরিফ মোহাম্মদ ও মো. শফিউল আলম। আরেক অ্যানিমেশন ফিল্ম ‘মুজিব আমার পিতা’ মুক্তি পায় ২০২১ সালের ১ অক্টোবর। শেখ হাসিনার ‘মুজিব আমার পিতা’ বই অবলম্বনে এ সিনেমাটি নির্মিত হয়। মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে নির্মিত ৪০ মিনিটের এ সিনেমায় প্রতি মিনিটের ব্যয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। মোট ব্যয় ৩ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অ্যানিমেশন তৈরিতে কাজ করে প্রোলান্সার স্টুডিও। সরকারি খরচে যুক্তরাষ্ট্রে এ সিনেমার বিশ্ব প্রিমিয়ার করে আইসিটি বিভাগ। এ সিনেমারও রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন তণ্ময় আহমেদ। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বিপুল অর্থায়নে নির্মিত আরেকটি অ্যানিমেশন সিরিজ ‘খোকা’। ৯৩ মিনিটের এ অ্যানিমেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১১ পর্বের এ অ্যানিমেশন সিরিজের পরিচালনায়ও ছিলেন প্রোলান্সার স্টুডিওর সোহেল মোহাম্মদ রানা।
অ্যানিমেশন এবং হলগ্রাফিকের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের আরেকটি উদাহরণ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) প্রজেকশন। লেজারের আলো ফেলে শেখ মুজিবুর রহমানের অবয়ব তৈরির এ প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় ২১ কোটি টাকা। যেখানে অত্যন্ত নিম্নমানের হলগ্রাফিক প্রযুক্তি ব্যবহার হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে কাজটি পান এনডিই সল্যুশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ এসএ হোসেইন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একই প্রকল্প থেকে বিপুল ব্যয়ে নির্মিত আরেকটি অ্যানিমেশন ফিল্ম ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’। শেখ রাসেলের জীবনী নিয়ে ত্রিমাত্রিক এ চলচ্চিত্র নির্মাণেও সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। এটি নির্মাণের কাজ দেওয়া হয় আইসিটি বিভাগে পলকের ঘনিষ্ঠ এএসএম আসাদুজ্জামানের কোম্পানি স্পিন অফ লিমিটেডকে। মাত্র ২৩ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এ অ্যানিমেশন ফিল্মটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে খরচ ১৩ লাখ টাকা।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে নির্মাণ করা হয়, সঁলরন১০০.মড়া.নফ নামে একটি ওয়েবসাইট। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত এ সাইটটির ওয়েবে কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ সাইটটিরই মোবাইল সংস্করণ তৈরি করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প।’ ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ‘মুজিব সেঞ্চুরি’ অ্যাপ্লিকেশনটি। এ অ্যাপ নির্মাণে বিপুল অর্থ লোপাটকারী ‘ইজি টেকনোলজি’র মালিক মফিজুর রহমান টিপু; যিনি পলকের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসাবে পরিচিত। এ কারণে তিনি আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচার, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজ পেতেন। সর্বশেষ মার্চে ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের দেড় কোটি টাকার একটি কাজ পেয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে মফিজুর রহমান টিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে মুঠোফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অর্থ লোপাটে একই প্রকল্প থেকে ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় ‘বঙ্গবন্ধু অভিধান’ নামক মোবাইল অ্যাপ। বিপুল অর্থ ব্যয়ে এ অ্যাপ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাইম টেক সল্যুশনকে। গুগল প্লে স্টোরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০ মে উন্মুক্ত হওয়া অ্যাপটি এখন পর্যন্ত ৬০ জন ব্যবহারকারীও ইনস্টল করেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে অর্থ লোপাট এখানেই শেষ হয়নি। ‘মুজিব জিজ্ঞাসা’ নামে একটি চ্যাটবট তৈরি করা হয় ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে। হেডলেস নামক প্রতিষ্ঠানের এ চ্যাটবট তৈরিতেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর যুগান্তরকে বলেন, এটি আসলে একটি প্রকল্পই নয়, বরং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সব প্রকল্পেই বিগত বছরে দুর্নীতির এমন মহাযজ্ঞ চলেছে। তারা যে যেভাবে পেরেছে, লুটপাট করেছে। আমি মনে করি, যেসব প্রতিষ্ঠান এসব লুটপাটের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি বদিউল আলম খোকন বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি এসব ফিল্ম ও অ্যাপ দেশের মানুষের কোনো কাজে আসেনি। তারা চাইলে দেশের ইতিহাস নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করতে পারত, যেটাতে দেশের মানুষ উপকৃত হতো এবং সঠিক ইতিহাস জানতে পারত। নিজেদের পকেট ভারী করতে তারা এমন সব ফিল্ম বানিয়েছে, যা শুধু অর্থের অপচয়। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নিম্নমানের এ অ্যানিমেশনগুলো দেশের মানুষের কোনো উপকারে আসেনি, বরং এসব প্রকল্প নেওয়াই হয়েছে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যে। আর হলগ্রাফিক প্রজেকশনে তারা এতই নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, যে কারণে বিমান থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের হাত নেড়ে নামার সময়ে দেখা যায়, শুধু একটি আলোর পিণ্ড এগিয়ে যাচ্ছে লালগালিচাতে। এসব প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, মূলত দেশের অ্যানিমেশন শিল্পের উন্নয়নের জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া আমি দায়িত্বে আসার আগেই এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।