বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঢামেক মর্গে মিলে লাশ
এটিএম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
কিশোর জুবায়েদ বেলা ১১টার দিকে গিয়েছিল কাজে। নাশতা না করেই বের হয়েছিল। দুপুরে বাসায় ফিরে খাবে বলে গিয়েছিল। তাই দুপুরের খাবার রান্না করে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মা। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেও ছেলে আর ফিরেনি। অবশেষে তাকে পাওয়া গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছিলেন জন্মদাত্রী মা।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের গোকুলনগর গ্রামের নাজির হোসেন-হোসনে আরা বেগম দম্পতির বড় ছেলে ফার্নিচার মিস্ত্রি কিশোর জুবায়েদ (১৬) গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর দুপুরে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
জানা যায়, অভাব-অনটনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম জুবায়েদ ৭ মাস আগে বাবা, মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকার শনিরআখড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় ওঠে। শনিরআখড়ার ৫নং গলিতে একটি ফার্নিচারের দোকানে মিস্ত্রি হিসাবে কাজও পেয়ে যায়। একই এলাকার ১নং গলির একটি টেইলারিং দোকানে ছোট ভাই জুনায়েদকেও (১৪) দর্জির কাজে লাগিয়ে দেয়। বাবা নাজির হোসেনও সংসারের চাপ কমাতে মাঝেমধ্যে রিকশা নিয়ে বের হতেন। এভাবেই চলছিল তাদের টানাপোড়েনের সংসার। এর মধ্যে জুনে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মাঝেমধ্যে সেই আন্দোলনের মিছিলেও যোগ দিত জুবায়েদ।
৫ আগস্ট দুপুর ১টায় জোহরের আজান হলে ফার্নিচার দোকানের মালিক তাকে বাসায় চলে যেতে বলেন। কিন্তু জুবায়েদ বাসায় না গিয়ে চলে যায় হাসিনা সরকারের পতনের বিজয় মিছিলে। শনিড়আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গিয়ে মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়। তাকে মিছিলকারীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
এদিকে, দুপুরের খাবার রান্না করে একসঙ্গে খাওয়ার জন্য ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলেন মা হোসনে আরা বেগম। কিন্তু জুবায়েদ ফেরেনি। অনেকবার ফোন করেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেও তার কোনো খোঁজ মিলছিল না। বিকালের দিকে তার খোঁজে বের হন মা, বাবা ও ছোট ভাই। আশপাশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে জুবায়েদের ছবি দেখান তারা। কোথাও নেই। তখন লোকজনের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। রাতে সেখানে গিয়ে রিসেপশনে ছবি ও নাম দিয়ে খুঁজেন তাকে। জানা যায়, এমন নামে কেউ ভর্তি হয়নি। এ সময় একজন ছবি দেখে বলেন, মর্গে গিয়ে দেখতে পারেন-এমন একটি মরদেহ মর্গে দেখে এসেছি। তারপর মর্গে গিয়ে মিলল গুলিতে ঝাঁজরা জুবায়েদের মরদেহ। জুবায়েদের ডান চোখে একটি গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। এছাড়াও শরীরে ছিল অসংখ্য গুলির ক্ষতচিহ্ন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে জুবায়েদের মরদেহ শনাক্ত করেন পরিবারের লোকজন। দেশ যখন স্বৈরাচারমুক্তির আনন্দে ভাসছে, জুবায়েদের পরিবার তখন কান্না ও শোকের সাগরে ভাসে। রাতেই বাড়িতে আনা হয় জুবায়েদের মরদেহ। পরের দিন পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের গোকুলনগর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় জুবায়েদের মা হোসনে আরা বেগম, ছোট ভাই জুনায়েদ ও তার নানা বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে। জুবায়েদের বাবা রিকশা নিয়ে তখন বাইরে ছিলেন।
বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে মা হোসনে আরা জানান, সাড়ে ১১টার দিকে গোসল করে সকালের খাবার না খেয়েই কাজের উদ্দেশ্যে দোকানে যায় জুবায়েদ। সকালে খেয়ে যায়নি বলে দুপুরের খাবার রান্না করে বসে ছিলেন তিনি ছেলের জন্য। বিকাল ৪টার দিকে ছেলেকে খুঁজতে বের হন তারা। মা হোসনে আরা বেগম চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। এছাড়াও যারা এই আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন, তাদের পাশে যেন বর্তমান সরকার দাঁড়ায়, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়-সেই দাবি জানাই।’
নানা ষাটোর্ধ্ব বাচ্চু মিয়া বলেন, জোবায়েদ নিহত হওয়ার কয়েকদিন আগেও ফোন করে আমাকে বলেছিল সে মিছিলে গেছে। আমি ফোনে তাকে মানা করেছিলাম যে আমরা গরিব মানুষ কাজ করে খাই, মিছিলে গিয়ে কী হবে। জুবায়েদের মৃত্যুর পর তার পরিবারের সবাই বাড়িতে চলে এসেছে। জুবায়েদকে হারিয়ে এখন পরিবারের সবাই দিশেহারা। সরকার যদি জুবায়েদের ছোট ভাই জুনায়েদকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে তাদের জন্য ভালো হতো। জুবায়েদের মৃত্যুর পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান পায় তারা।
শনিরআখড়ার রাসেল ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী রাসেল মিয়া বলেন, জুবায়েদের মৃত্যুতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমি তার হত্যার বিচার চাই।