গোল্ড মাফিয়া আবুর অপরাধ সাম্রাজ্য
মুড়ি বিক্রেতা আবু ৭২১ কোটি টাকার মালিক
কায়েস আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের গোল্ড স্মাগলিং এবং হুন্ডির গডফাদার হিসাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ সোনা বা হুন্ডি চোরাকারবারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফতেপুর গ্রামের ফয়েজ আহমেদ ওরফে বলি সওদাগরের ছেলে আবু আহমদ ওরফে আবু। একসময় জীবিকার তাগিদে দেশে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন তিনি। সেই কাজ ছেড়ে ১৯৯১ সালে শ্রমিক ভিসায় দুবাই যান আবু। এর কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে আরব আমিরাত আর বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছেন তিনি। স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসায় তাকে গডফাদার হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর হিলভিউ আবাসিক এলাকার বাসার সামনে থেকে হঠাৎ অপহৃত হন আবু। তখনই প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ওঠে আসে আবু নামের রহস্যময় এক বিত্তশালীর নাম। প্রায় ১০ বছর আগের সেই অপহরণের ঘটনায় আবু ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান অজ্ঞাত একদল দুর্বৃত্তের হাত থেকে। এ ঘটনার ৫ মাস পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলার পর অপহরণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়।
তবে স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার হিসাবে আবুর নাম প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে। ওই বছর ঢাকায় চোরাচালানের স্বর্ণ উদ্ধারের পরপর তিনটি ঘটনায় দৃশ্যপটে চলে আসেন আবু। এর মধ্যে ১০৫ কেজি ওজনের ৯০৪ পিস স্বর্ণের প্রথম চালানটি ধরা পড়ে রাজধানীর শাহজালাল বিমানবন্দরে। পরে একই বিমানবন্দরে ৫২৫ পিস স্বর্ণের বারসহ ধরা পড়ে বিপুল পরিমাণ সৌদি মুদ্রার অপর একটি চালান। ৬১ কেজি স্বর্ণের অপর একটি চালান ধরা পড়ে ঢাকার নয়াপল্টন থেকে। এসব ঘটনায় ঢাকা বিমানবন্দর থানা ও পল্টন থানায় আবুর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট থেকে স্ত্রী খুনের মামলায় আলোচিত তৎকালীন নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে উদ্ধার করা হয় তিনটি সিন্দুকভর্তি বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও নগদ টাকা। এর মধ্যে একটি সিন্দুক থেকে ২৫০টি স্বর্ণের বার এবং অন্য এক সিন্দুকে পাওয়া যায় ৬০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় আবু ও তার ম্যানেজার এনামুল হক নাঈমকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়।
এ মামলায় আবুকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু নাটকীয় কায়দায় তিনি মাত্র ৫ মাসের মাথায় চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বের হয়ে যান। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী কোনো একসময় হাইকোর্টের দুই বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে একটি পিটিশন তৈরি করান আবু। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি মিস শাখার মাধ্যমে সেই পিটিশনটি বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ভুয়া স্থগিতাদেশ তৈরি করে তথ্য গোপনের মাধ্যমে জামিন নিয়ে ওই বছরের আগস্টে তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে যান। এরপর একনাগারে নিরবচ্ছিন্নভাবে তার অবৈধ এ ব্যবসা চলতে থাকেন; কিন্তু গত বছর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে দুবাই পালিয়ে যান। আবার চলতি বছর দেশে ফিরে এসে নতুন সিন্ডিকেট করে অবৈধ সোনার ব্যবসা চালু করেন। এরপর থেকে বেড়ে গেছে হুন্ডি ও স্বর্ণ পাচারের ঘটনা। সবার প্রশ্ন আবুর খুঁটির জোর কোথায়?
আবুর অপরাধনামা : ২৪০ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা পাচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ মামলা হয়েছিল আবুর বিরুদ্ধে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়ে সিআইডি ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে আদালতে। স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় অভিযুক্ত আবু আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তার অবৈধ অর্থের খোঁজ পায়। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত ২১ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি।
জানা যায়, আবু আহমেদ চট্টগ্রামে অর্থ পাচার এবং স্বর্ণ ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভবন, প্লট, বিলাসবহুল বাড়ি। দুবাইয়েও তার তিনটি দোকান রয়েছে। তদন্তে প্রমাণ মিলেছে ফরহাদ ট্রেডিং, রিয়াল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রূপা টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন আবু আহমেদ। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা।
তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের টাকা নিয়ে তিনি হুন্ডি ব্যবসা করেন। এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান করতে করতে তিনি পরিচিতি পান সোনা আবু নামে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ মিলেছে তার নামে কেনা ২৪টি জমির। সেই সঙ্গে নগরীতেই আছে বিলাসবহুল অন্তত তিনটি বাড়ি!
আবুর সহযোগী : চোরাচালান ও হুন্ডির কারবারে আবুর প্রধান সহযোগী ফটিকছড়ির ফতেহপুরের ইকবাল আহমেদ ওরফে নিজামের চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গত এক যুগে জমা হয়েছে ৫২ কোটি টাকা। ফটিকছড়ির জাফতনগরের নুর মোহাম্মদের ছেলে আবু রাশেদের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এ পর্যন্ত জমা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিদেশেও নিয়ে গেছেন এই রাশেদ। এ কাজে তিনি তার কর্মচারী হাবিবুর রহমান, মায়নুল হাসান রবি, মো. সোলাইমান, মুহাম্মদ পারভেজ মিয়া, মো. সাহাবুদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, আবদুর রহিমকে ব্যবহার করেছেন। একইভাবে চোরাচালান চক্রের সদস্য ফটিকছড়ির দক্ষিণ রোসাংগিরির ওবায়দুল আকবর ফতেহপুরের মোহাম্মদ রফিক ফটিকছড়ির জাহানপুরের জিয়াউদ্দিন বাবলু চন্দনাইশের হাশিমপুরের ইমরানুল হক মো. কফিল চৌধুরী। এছাড়া ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা এমতিয়াজ হোসেন। অভিযোগের বিষয়ে আবু আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এগুলো অনেক পুরোনো বিষয়। আমাকে সব জায়গা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে। পরে আবু আহমদকে অব্যাহতিপত্র দেখাতে বললে তিনি দেখাতে পারেননি। মুড়ি বিক্রেতা থেকে আপনি এত টাকার মালিক হলেন কীভাবে? এর জবাবে তিনি বলেন, এর কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে না।