দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ
দায়সারা প্রকল্প তৈরি শুরুতেই ধাক্কা
পরিকল্পনা কমিশনও দায় এড়াতে পারে না : সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ
দায়সারা প্রকল্প তৈরি শুরুতেই ধাক্কা, ফাইল ছবি
সারা দেশে ১ হাজার ৩৩৩টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণের শুরুতেই লেগেছে নানা ধাক্কা। দায়সারা প্রকল্প তৈরি, এডিপিতে বরাদ্দ না থাকা, কোড জটিলতা, ডিপিপিতে কোনো পরামর্শকের সংস্থান না রাখা এবং গাড়ি কেনার সংস্থান না থাকার বিষয়গুলো সামনে আসছে। ফলে সময়মতো প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ‘সমগ্র দেশে শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্ব)’ প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি অনিুষ্ঠিত পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের এ ভূমি ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) জিয়াউদ্দীন আহমেদ।
সূত্র জানায়, শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণের জন্য দ্বিতীয় পর্বে নেওয়া এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এটি ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু প্রকল্পের শুরু ২০২৩ সালের জুলাই হলেও জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার) জারি করা হয় ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ। এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক আদেশ জারি করে আরও প্রায় এক মাস পর ৩ এপ্রিল। এ কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) কোনো বরাদ্দ রাখা যায়নি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বরাদ্দ আছে ১৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সেই টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে জটিলতা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, কোড না থাকা কিংবা কোডের আওতায় কম-বেশি বরাদ্দের বিষয়টি অবশ্যই ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়। তবে পরিকল্পনা কমিশনও এই দায় এড়াতে পারে না। যখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় তখন এসব পুঙ্খানপুঙ্খ দেখা উচিত ছিল। এছাড়া প্রকল্পটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন এলজিইডিকে দেখিয়ে নেওয়া হয়েছিল কিনা সেটি একটি প্রশ্ন। যদি সেটি করা না হয় তাহলে ভূমি মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এ প্রকল্পের জন্য একজন পরামর্শক রাখলেই হয়তো চলত।
কিন্তু অন্য কাজের জন্য পরামর্শকের প্রকৃত প্রয়োজন আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুরুতেই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে অবশ্যই মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
পিআইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) কিছু কোডে প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া আছে। আবার কিছু কোডে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া আছে। সেই সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় কিছু কোড ডিপিপিতে নেই। তিনি আরও জানান, এই প্রকল্পে ১০ জন আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের সংস্থান রয়েছে। কিন্তু সব প্রক্রিয়া শেষ করে এ জনবল নিয়োগে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস সময় প্রয়োজন। এই সময়ের মধ্যে কাজ চালানোর জন্য অনুমোদিত ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী ৫ জন অনিয়মিত শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের মজুরি বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা ধরে ৬ মাসের জন্য প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোডে বরাদ্দ আছে মাত্র ১ লাখ টাকা। ফলে এসব শ্রমিক-কর্মচারী ৩ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। তারা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা অফিসে আসা বন্ধ করে দিলে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হবে না। প্রকল্প পরিচালক পিআইসি সভায় জানান, এর আগে ‘সমগ্র দেশে শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের আওতায় ১ হাজার ৫০টি ভবন নির্মাণের সংস্থান ছিল। এক্ষেত্রে ফাউন্ডেশন, মাটি পরীক্ষা, টপোসার্ভে, ডিজাইন এবং ড্রইংয়ের জন্য ১৪ জন পরামর্শকের সংস্থান ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ৩৩৩টি ভবন নির্মাণের জন্য কোনো পরামর্শকের সংস্থানই রাখা হয়নি। ফলে জনবল সংকটের কারণে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সময়মতো শেষ করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। এরই মধ্যে এলজিইডি জানিয়েছে পরামর্শক ছাড়া প্রকল্পের কাজ সময়মতো বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে। তিনি আরও জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক সব কাজ (যেমন আইবাস প্লাস প্লাস, ইপিআইএমএস, এএমএস, এডিপি, আরএডিপি এবং ই-মেইল ইত্যাদি) করতে একটি কোম্পানি থেকে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোডটি ডিপিপিতে না থাকায় তাদের বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ৮টি কোড প্রকল্প দলিলে যুক্ত করা হয়নি। পিআইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, যেহেতু পরামর্শক ব্যয় অনুমোদিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই; কিংবা কোনো অর্থসংস্থান রাখা হয়নি। এ অবস্থায় পরামর্শক ব্যয় যুক্ত করতে হলে প্রকল্প সংশোধন করা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রকল্প পরিচালক ওই সভায় জানান, বাস্তবতা বিবেচনায় ৮টি নতুন অঙ্গ প্রকল্পে যুক্ত করা প্রয়োজন। এজন্য আন্তঃখাত সমন্বয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু সভায় তার এই প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে বলা হয়, অনুমোদিত প্রকল্পে যেসব অঙ্গের অনুমোদন আছে শুধু সেক্ষেত্রেই আন্তঃখাত সমন্বয় হতে পারে। কিন্তু একেবারেই নতুন অঙ্গ হলে প্রকল্প সংশোধন ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছে।